আহলে বাইতের মর্যাদা ও কারবালার শিক্ষা

হিজরি নববর্ষ, মহররম মাস, আশুরা তথা মহররমের ১০ তারিখ, কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ও আহলে বাইতের মহব্বত এবং আহলে বাইত পরিচিতি একেকটি স্বতন্ত্র বিষয়। এর প্রতিটি বিষয় অন্যগুলোর পরিপূরক, কোনোটিই অন্যটির বিপরীত বা সাংঘর্ষিক নয়। সৃষ্টির আদি থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আশুরার তাৎপর্য বিদ্যমান, হিজরি সনের প্রচলন মহররম মাসকে অধিক স্মরণীয় করেছে, কারবালার করুণ ইহিতাস আশুরা ও মহররমের ইতিহাসে গৌরবের নতুন পালক যুক্ত করেছে এবং মহিমান্বিত ও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।

আহলে বাইত

কোরআনিক অর্থে নবীজি (সা.)–এর আহলে বাইতের সদস্য ছিলেন চারজন—ফাতেমা (রা.), আলী (রা.), হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)। মর্যাদার দিক থেকে তাঁরাই সবার ঊর্ধ্বে। নবীপত্নীরাও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তারা বলল, তুমি কি আল্লাহর কাজে বিস্ময়বোধ করছ? হে আহলে বাইত! তোমাদের ওপর সর্বদা আল্লাহর বিশেষ রহমত ও তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি মহাপ্রশংসিত ও মহামর্যাদাবান (১১:৭৩)।’ এই আয়াতে ইব্রাহিম (আ.)–এর পত্নীদের ব্যাপারে আহলে বাইত শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং শাব্দিক ও প্রায়োগিক অর্থে নবীপত্নীরাও আহলে বাইতের সদস্য।

ব্যক্তির স্ত্রী-পুত্র, সন্তানসন্ততি, নিকটাত্মীয়–স্বজনসহ পরিবারের সব সদস্যকেই তার আহলের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। কোরআন মাজিদে উল্লেখ হয়েছে, ‘অতঃপর সে বলল, আমি কি তোমাদেরকে এমন “আহলে বাইত”–এর সন্ধান দেব? যারা তোমাদের জন্য তাকে লালন–পালন করবে এবং তারা তার শুভার্থী হবে (২৮:১২)।’ এখানে মুসা (আ.)–এর পরিবারকে আহলে বাইত বলা হয়েছে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর পরিবারের সদস্য, সব নিকটাত্মীয় ও আওলাদে রাসুলেরা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

আহল ও আল

আহল অর্থ পরিবার-স্বজন, আল অর্থ অনুগামী-অনুসারী। আল ও আহল শব্দদ্বয় কখনো সমার্থকরূপে, কখনো ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমরা দরুদ শরিফে বলি, ‘আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ আপনি পরিপূর্ণ রহমত ও বরকত দান করুন হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি ও তাঁর স্বজনদের প্রতি। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সকল খাঁটি বিশুদ্ধ বিশ্বাসী মুমিন আমার আল বা স্বজন।’ (আহমাদ)।

হজরত নুহ (আ.)–এর ঔরসজাত সন্তানও কর্মদোষে আল বা আহল হতে পারেননি। কোরআনের বর্ণনা, ‘নুহ (আ.) তাঁর রবকে আহ্বান করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই সে আমার পুত্র-আমার আহল আর আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আপনি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক। বললেন, হে নুহ! নিশ্চয়ই সে আপনার আহল নয়, কারণ তার কর্ম সঠিক নয় (১১:৪৬)।’

আহলে বাইতে রাসুল (সা.)–এর মর্যাদা

কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার উম্মতদের বলে দিন, আমি আমার দাওয়াতের বিনিময়ে আমার আহলে বাইতদের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না (২:২৩)।’ ‘হে আহলে বাইত! আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে (৩৩:৩৩)।’ নবীপত্নী উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘যখন আমার গৃহে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল, তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) ফাতেমা, আলী, হাসান ও হোসাইনকে চাদরাবৃত করে বললেন—হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বাইত।’

আহলে বাইতে রাসুল (সা.)–এর সম্মান

গাদিরে খুমের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন: ‘আমি তোমাদের জন্য অতি মূল্যবান দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, একটি আল্লাহর কিতাব, অপরটি হচ্ছে আমার রক্তসম্পর্কীয় নিকট স্বজন “আহলে বাইত”। তোমরা যদি এ দুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’

আওলাদে রাসুল (সা.) ও সাইয়ে্যদের পরিচয় ও মহত্ত্ব

আওলাদে রাসুল (সা.)–এর অর্থ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সন্তান বা বংশধর। তঁারা বিশেষ সম্মানের অধিকারী। আওলাদে রাসুল মানে আহলে বাইত নয়। নবী করিম (সা.)–এর বংশধরেরা সাইয়্যেদ নামে পরিচিত। তঁারা আওলাদে রাসুল (সা.)–এর অন্তর্ভুক্ত। ইমান, আমল ও তাকওয়াই মর্যাদার মাপকাঠি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে, অতঃপর তোমাদিগকে বিভিন্ন শাখা ও গোত্রে বিভাজন করেছি, যাতে তোমরা পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের সে–ই বেশি সম্মানিত, যে বেশি তাকওয়াবান (৪৯:১৩)।’

কারবালার শিক্ষা

মহররম মাস আসবে প্রতিটি বছর ঘুরে, আশুরা আসবে বারবার ঘুরেফিরে, কারবালা আসবে প্রতিটি সংকট মুহূর্তে। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)–এর ফোরাততীরে কারবালার প্রান্তরে আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়ের শিক্ষা। কারবালার শিক্ষা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শিক্ষা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (বুখারি ও তিরমিজি)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com