আহ্ এরশাদ! উহ্ গণতন্ত্র!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

আহা এরশাদ! আত্মহত্যা ঘোষণার পরদিন সকালে তিনি ‘ভালো’ আছেন! তাঁর গুলিভরা চারটি পিস্তল বা চারটি গুলিভরা একটি পিস্তলও ঘুমিয়ে আছে। জাগিবার গাঢ় বেদনার স্বাদ তাদের নিতেও হয়নি, দিতেও হয়নি। সবই বেশ শান্তি শান্তি, কল্যাণ কল্যাণ হয়ে আছে। সকালবেলা ঘুম ভেঙে এরশাদেরও মনে হয়েছে, তিনি ভালো আছেন!
এই লারেলাপ্পা দেখে কারও মনে হতেই পারে, ২৩ বছর আগে এই দিনে তাঁর পতন হলেও যিনি আত্মহত্যার কথা চিন্তাও করেননি, সেই তিনি এখন আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছেন! বলতে পারেন, সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি! জবাবে এরশাদ হিন্দি নায়ক শাহরুখের গানের ভাষায় বলবেন, ‘সুরুয হুয়া মধ্যম। ম্যায় ঠেহরা রাহা, জমি চলনে লাগি’। আমি তো দাঁড়িয়ে আছি, মাটিই তো চলা শুরু করেছে। রাজনীতির জমিতে কত ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, এরশাদের ডিগবাজির অভিনবত্ব তার প্রমাণ। কারণ, ক্ষমতার সূর্য তাঁর ওপর তাপ ঢালছে। এরশাদ হলেন ক্ষমতার গলায় ঝোলানো ঘন্টি। ক্ষমতা যত কাঁপে, তিনিও ততই বাজেন।
সব ফুলে নৈবেদ্য হয় না। ধুতরা ফুলের মালা কেউ গলায় পরে না। এরশাদের আত্মদানে গণতন্ত্রের কোনো কাজ নেই। দান করার মতো তাঁর কিছুই নেই, নেওয়ার আছে অনেক কিছু। তাঁকেও আমাদের দরকার অন্য কারণে। তিনি না থাকলে কীভাবে বুঝতাম, পর্দার অন্তরালে কত খেলা, কত কেনাবেচাই না চলছে! এ মুহূর্তে তিনিই বাংলাদেশের কেনাবেচার রাজনীতির ব্যারোমিটার। তাঁকে দিয়েই রাজনীতির আদর্শ, ঐক্য, নির্বাচন ইত্যাদির পরিহাস ধরা পড়ে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগে এরশাদ ছিলেন রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং তথা দল-নেতা-এমপি কেনাবেচার সওদাগর। এভাবেই তিনি দল গড়েছিলেন, এভাবেই তাঁর আমলে ‘সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ’ সর্বদলীয় নির্বাচন করিয়ে নিয়েছিলেন। এখন তিনি রাজনীতির বাজারের পণ্য। পার্থক্যটা এখানেই, আগে তাঁর কাছে নেতা-নেত্রীরা বিক্রি হতেন, এখন তিনি বিক্রি হন। আগে যাঁদের কিনতে চাইতেন, এখন তাঁরাই তাঁকে কিনে রাখতে চান। তাই কেউ যদি শুধান, এরশাদ তুমি কার? উত্তর: যে দেবে বেশি, আমি হব তার।
গত এক মাসে এরশাদের ভোল বদলানো দেখে অনেকের মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা। একবার এক শিয়াল বনমোরগকে ধরবার ফন্দি হিসেবে তার সামনে লেজটাকে চরকির মতো ঘুরানো শুরু করল। মোরগ ভাবে, এ কী রে? লেজ দিয়ে শিয়াল কী-না-কী করে, সেই উত্তেজনায় মোরগ তার ঘুরন্ত লেজে নজর সেঁটে রাখল। এই করতে করতেই তার নিজের মাথা এমনই ঘুরতে শুরু করল যে, সে ডাল থেকে অজ্ঞান হয়েপড়ল মাটিতে। রাতের ভোজটা জম্পেশ হলো শিয়ালের। আমরাও এরশাদের ডিগবাজি নিয়ে মেতে আছি, বিনোদিত হচ্ছি। ওদিকে অন্তরালেচলছে শেষ দৃশ্যের আয়োজন।
কিন্তু লেজটা ঘুরছে কিসের জোরে? গত ২৩ বছর এরশাদ যে রাজনীতি করছেন, তাকে বলা যায় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। লেজের দেহ প্রয়োজন, দেহের লেজ প্রয়োজন। এভাবে তিনি একবার এই পক্ষে, একবার ওই পক্ষে নাইওর খেয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর এই ‘ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি’ স্বভাব দেখে কেউ ক্ষিপ্ত হন, কেউ আমোদ পান। যেন, হাস্যকর সুবিধাবাদী আচরণ যা করার, এরশাদ একাই করছেন। কিন্তু যাঁরা তাঁকে ঘোরাচ্ছেন, ওঠাচ্ছেন-বসাচ্ছেন, এই লজ্জা কি তাঁদেরও নয়? এরশাদ জাতীয় লজ্জা হলে, তাঁকে যাঁরা সাজিয়ে-গুছিয়ে রাজনীতির ময়দানে পরিবেশন করেন, তাঁদের নাকও কাটা পড়া উচিত। নব্বইয়ের পর প্রথম বিএনপির আমলে তাঁর বিচারে গড়িমসি করা হয়। বিচারের নামে টালবাহানা করে তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হয়। তিনি নির্বাচনের সুযোগ পান এবং জেল থেকে নির্বাচিত হন। পরের আওয়ামী লীগ আমলে তাঁর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়। এই আমলে এরশাদ হয়ে ওঠেন মহাজোটের মহাসখা। এরশাদের এই রাজনৈতিক নবযৌবন গণতন্ত্রের শিরোপাধারী দুই নেত্রীর উপহার! এরশাদের কীর্তির দায় তাঁদেরও নিতে হবে।
এরশাদের রাজনৈতিক গম্ভীরা দেখে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। এটাই বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড। যাঁর ক্ষমতা সেই ১৯৯০ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাঁকে যাঁরা রাজনৈতিক পুনর্জন্ম দিয়ে চলেছেন, এই এরশাদের দায় প্রথমত তাঁদের। হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রূপ কেন কেবল এরশাদের প্রাপ্য হবে? এই লজ্জা ও দায় সেসব বিদেশি কূটনীতিকেরও, যাঁরা তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর কী করা উচিত, সে বিষয়ে পরামর্শ বা চাপ দিয়ে আসেন। হায় গণতন্ত্র!
এরশাদ বাংলাদেশের ক্ষমতা-ব্যবসাকেন্দ্রিক রাজনীতির সুপারবয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাঁর অভিভাবকদের কাছেই করতে হবে। ২৩ বছর আগে যাঁর পতনে গণতন্ত্রের জয়ঘোষিত হয়েছিল, আজ তাঁকে জয়করাই নাকি গণতন্ত্র অর্জনের শর্ত! দুই দল সেই শর্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]