ইতিহাস কি আবার তালেবানদের পক্ষে?

সম্প্রতি কাতারের দোহায় আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবান নেতাদের আলোচনা হয়।ছবি: এএফপি

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর। আফগানিস্তানে তখন প্রাক্‌-শীত মৌসুম। বছরের এই সময় কাবুলের আবহাওয়া থাকে মনোরম। কয়েক মাস পরই বরফ পড়ার ঋতু।

ঠিক এই সময়ই তালেবানরা দুনিয়া কাঁপিয়ে কাবুলে ঢুকছিল। আর তখনই সেই কুৎসিত ঘটনাটি ঘটে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নজিবুল্লাহকে তাঁর ভাই শাহপুর আহমেদজিসহ হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হলো শহরে রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশের ট্রাফিক পোস্টে। দুদিন এভাবেই ঝুলে থাকলেন নজিবুল্লাহ। তালেবানদের বাধায় কাবুলে তাঁদের কবরও দেওয়া গেল না।

নজিবুল্লাহর স্ত্রী ও কন্যা নয়াদিল্লি থেকে মর্মপীড়াদায়ক এসব সংবাদ শুনে গেলেন আটচল্লিশ ঘণ্টাজুড়ে। এভাবেই শুরু হলো ইতিহাসখ্যাত তালেবান শাসন।

নজিবুল্লাহর সঙ্গে ভারতের বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। পুরোনো মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তত দিনে ভেঙে গেছে। মুজাহিদিনদের আক্রমণে ১৯৯২ সালে পদত্যাগের পর স্ত্রী-কন্যাকে ভারত পাঠিয়ে নজিবুল্লাহ নিজেও সেখানে চলে যাবেন ভেবেছিলেন। জাতিসংঘও সেটা চাইছিল। একটা বিমানও পাঠায় ভারত। উজবেক নেতা আবদুর রশিদ দোস্তামের বাধায় শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ সফল হয়নি। এমনকি কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েও পাননি নজিবুল্লাহ। হত্যার আগে তাঁকে জাতিসংঘের স্থানীয় কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

নজিবুল্লাহর নির্মম হত্যাযজ্ঞ তালেবানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে এক ঐতিহাসিক কাঁটা হয়ে আছে বলে মনে করা হতো এত দিন। কিন্তু বিশ্ব সব সময় বিজয়ীর সঙ্গে থাকতে চায়। কাবুলে রাজনৈতিক সমীকরণ যতই তালেবানদের পক্ষে যাচ্ছে, নয়াদিল্লি ততই সেই একই তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে চাইছে এখন। কিন্তু কেন তা জরুরি?

ভারতীয় বন্দীদের ছেড়ে দিল তালেবানরা

তালেবানদের প্রতি আগ্রহী হওয়ার প্রধান এক ভারতীয় কারণ অবশ্যই পাকিস্তান। ভারত-পাকিস্তান রেষারেষির পরবর্তী অধ্যায় কাশ্মীর থেকে আফগানিস্তানের দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। পাকিস্তান ভাবছে তালেবানদের সঙ্গে তার পুরোনো সম্পর্ককে সম্বল করে ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে তার প্রভাব হতে পারে একচ্ছত্র। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে এতে। ভারত যেকোনো মূল্যে এ অবস্থা রুখতে তৎপর। ফলে তালেবানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে তার সামনে বিকল্প কোথায়?

আফগানিস্তানের পুরোনো ‘বৈধ সরকার’ হিসেবে তালেবানদের দাবি ভারত এখনো মানে না। কিন্তু এরপরও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১২ সেপ্টেম্বর দোহায় তালেবানদের সঙ্গে আফগান সরকারের আলোচনার সময় অনলাইনে ভিডিও লিংকে বক্তৃতা দিলেন।

তালেবান উপস্থিতি আছে, এমন কোনো আসরে ভারতীয় মন্ত্রীর প্রকাশ্যে দেখাদেখি-মুখোমুখি এই প্রথম। খোদ সেই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিল ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তানবিষয়ক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জে পি সিংয়ের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল।

তালেবানরাও বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ করছে। দোহায় যাওয়ার আগে আটক শেষ ভারতীয়কেও ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে বাঘলান প্রদেশ থেকে ভারতীয় এক কোম্পানির এসব কর্মীকে তুলে নিয়েছিল তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি স্বাক্ষরের পর তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গণি বারদার পাকিস্তান, রাশিয়া, ইরান এবং চীনকে ধন্যবাদ দিলেও সেই তালিকায় নয়াদিল্লির উল্লেখ ছিল না। বার্তাটি স্পষ্ট। এরপরও অবশ্য ভারত মন খারাপ করে বসে নেই।

তালেবানদের স্বীকৃতি দেবে ভারত?

আজকের আফগানিস্তানে ভারত দ্বিতীয় প্রধান ‘দাতা’। তালেবানমুক্ত সমৃদ্ধ আফগানিস্তান ভারতের প্রবল কামনা ছিল। ন্যাটো সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রও আর এই যুদ্ধের খরচ জুগিয়ে যেতে রাজি নেই। সম্মানজনক বিদায়ের পথ খুঁজছিল তারা। তাদের এই পিছুহটায় ভারতের দুঃসময়ের শুরু।

তালেবানরা যুদ্ধের ময়দানে ১৯ বছর থাকার পর এখন নিশ্চিতভাবেই জানে, ন্যাটোর বাইরে কারা কারা আফগান সরকারকে সমর্থন-সহায়তা দিয়ে গেছে। বিশেষ করে তালেবানবিরোধী নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রতি ভারতের সহায়তা ছিল প্রকাশ্য এবং বিপুল।

ভারতকে এখন তাই তালেবানদের মান ভাঙাতে হবে। বাস্তববাদী তালেবানরাও অতীতকে সামনে টেনে এনে হয়তো হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বরং দর–কষাকষি করতে আগ্রহী হবে; যা আবার পাকিস্তানের সঙ্গে দর–কষাকষিতেও তাদের এগিয়ে রাখবে।

এসব হিসাব-নিকাশ থেকে আন্দাজ করা যায়, ভারত শিগগিরই হয়তো তালেবানদের স্বীকৃতি দিতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তাই চাইছে। ১৬ সেপ্টেম্বর ভারতে এসে শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের প্রধান অভিভাবক জালমে খালিলজাদও সেটাই হয়তো বলে গেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াটা স্পষ্ট। তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আগে আফগান শান্তি আলোচনায় একধাপ এগোনো দরকার। এ জন্য ওই অঞ্চলের সব খেলোয়াড়কে তারা ‘শান্তি প্রক্রিয়া’য় শামিল করতে চায়। ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকে বিশেষভাবে চায় তারা।

তবে ভারতের পরিবর্তনশীল আফগাননীতির পথে বড় বাধা বিজেপির সংখ্যালঘুনীতি এবং গরুকেন্দ্রিক রাজনীতি। মুসলমান সম্প্রদায়কে ঘিরে মোদি সরকারের নানা সিদ্ধান্তে আফগান জনগণের একাংশ খেপে আছে।

এ বছর দিল্লিতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আন্দোলনের সময় মুসলমানবিরোধী দাঙ্গার নিন্দায় আফগানিস্তানের বহু শহরে মিছিল হয়েছে। এত ভারতবিরোধিতা আফগানিস্তানে অতীতে দেখা যায়নি। বলিউডের সিনেমায় মুসলমানদের খারাপভাবে উপস্থাপন করা হলেও আফগানিস্তানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে ইদানীং। এ অবস্থায় তালেবানদের মধ্যে কেউ ভারতের প্রতি বেশি পক্ষপাত দেখাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এরপরও ওয়াশিংটন পাকিস্তান-তালেবান জোটের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসতে চাইছে না আফগানিস্তানকে। বিশেষভাবে চীন-পাকিস্তান মৈত্রীর মধ্যে এটা ওয়াশিংটনের জন্য আত্মঘাতী। ভারতকে তারা দোহা সমঝোতায় যেকোনোভাবে যুক্ত করতে আগ্রহী।

বলা বাহুল্য, পাকিস্তান ও চীনের তরফ থেকে বিরোধিতা থাকবে এতে। তালেবানদের একাংশও ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের হয়ে ভারতের প্রতি বৈরিতা দেখাবে। কিন্তু ভারতের জন্য সুবিধার দিকও আছে। আফগান সরকার তাদের পাশে পেতে আগের মতোই আগ্রহী। দেশটির সংখ্যালঘু ও নাগরিক সমাজের নারী প্রতিনিধিরাও তালেবানদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ভারতের মদদকে দরকারি ভাবছে।

শান্তি আলোচনা কাতারের বদলে সৌদি আরব বা আরব আমিরাতে হলে ভারতের জন্য আরেকটু সুবিধা হতো। এই দুই দেশের সঙ্গে মোদি সরকারের চমৎকার সম্পর্ক যাচ্ছে। কিন্তু তালেবানদের সঙ্গে সৌদ এবং জায়েদ বংশের হঠাৎ শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে।

তবে যত বাধাই থাকুক, তালেবান ও ভারতের পারস্পরিক স্বীকৃতি আসন্ন। আর যখনই এই দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি বৈঠক হোক, সেটা হবে প্রথম পক্ষের প্রবল নৈতিক বিজয়। সেই মুহূর্তটি অবশ্যই নজিবুল্লাহর পরিবারের জন্য চরম বেদনাময় হবে। ১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বর এবং ২০২০–এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতের বিদেশনীতির মোটা দাগে এই মোড় পরিবর্তনে তারা এখন শোকার্ত দর্শকমাত্র। এটাই ভূরাজনীতির বাস্তবতা। বিশেষ করে যখন চীন-ভারত-পাকিস্তান-ইরানের মধ্যে আফগানিস্তান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।

মধ্য এশিয়ায় পৌঁছানোর অভিলাষ ভারত কীভাবে ছাড়তে পারে?

পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ায় নিজ স্বার্থ রক্ষায় ইরান ও আফগানিস্তানই ছিল ভারতের বিকল্প ভরসা। এই উভয় দেশে হঠাৎই চীনের প্রভাব বেড়ে গেছে। প্রথম বিকল্পটি সম্প্রতি হাতছাড়া হলো। ইরান চাবাহার গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ভারতকে বাদ দিল কিছুদিন আগে। আবার ভবিষ্যতের আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে চীন তালেবানদের অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বলে প্রচার আছে। আফগানিস্তানজুড়ে ছয় লেনের সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিতে চায় তারা। যুদ্ধপরবর্তী সরকার চালাতে তালেবানরা এ রকম প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারে না।

কিন্তু মানচিত্রের উত্তর-পশ্চিমজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল বিস্তৃত মধ্য এশিয়ায় পৌঁছানোর অভিলাষ ভারত কীভাবে বাদ দিতে পারে? সুতরাং তালেবানদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব লাগবেই।

তালেবান নেতৃত্বের জন্য কূটনীতিক এসব দৃশ্য যে কত উপভোগ্য হয়ে উঠেছে, তা কল্পনা করাও দুরূহ। ইতিহাস কী নির্মমভাবে শক্তির পূজারি! নজিবুল্লাহর স্ত্রী ফাতানা নজিব এবং তাঁর তিন কন্যার বেদনার এ ক্ষেত্রে কোনোই মূল্য নেই!

আলতাফ পারভেজ: গবেষক