ইসরায়েলি টিকা বর্ণবাদের শিকার ফিলিস্তিনিরা

অন্য কোনো দেশ গাজা বা পশ্চিম তীরের অধিবাসীদের টিকা দিতে চাইলেও ইসরায়েলের অজ্ঞাতে দিতে হবে অথবা ইসরায়েলের মাধ্যমে দিতে হবে
ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে বিশ্ব কূটনীতি এখন এক উত্তুঙ্গ অবস্থায়। কে কাকে টিকা দেবে বা দেবে না; এ নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। টিকা কূটনীতির মূলে সক্রিয় আছে জাতীয়তাবাদী চেতনা। জাতীয়তাবাদ বরাবরই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ধারণা। জাতীয়তাবাদ এমন এক জিনিস, যা থাকলে ভয়ংকর খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে পারে। আবার না থাকলে রাষ্ট্রের ভেতরে ঐক্যের বন্ধন টুঁটে যেতে পারে। জাতীয়তাবাদ ভালো কি মন্দ তা নির্ণয় করা এই আলোচনার মূল বিষয় নয়।

তবে জাতীয়তাবাদ কতটা প্রয়োজনীয়, নাগরিক, রাষ্ট্রের জন্য আদৌ উপকারী কি না, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আজকাল শুরু হয়েছে। জাতিবাদী ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমরাই সেরা, এ মনোভাবের সৃষ্টি করে জনমনে। জাতীয়তাবাদের এ ধরনের ভয়ংকর মনোভাব কোভিড-১৯-এর টিকা কূটনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। ক্ষমতাধর ধনী দেশগুলো নিজেদের মতো করে টিকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। মানবিকতা, সাম্যের ভিত্তিতে টিকা বিতরণের কোনো নমুনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। আমিই বেঁচে থাকব, এ নীতি অনুসরণ করে বরং অন্যকে চাপে রাখা, অধিকতর মুনাফা অর্জন করাই এখানে মুখ্য কৌশল।

টিকা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আবার বর্ণবাদ যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে ফেলছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে দিয়ে টিকা জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। দখলকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজায় টিকা সরবরাহ করবে না ইসরায়েল। ইসরায়েল অন্য অনেক দেশের আগেই টিকা সংগ্রহ করে বসে আছে। দেশটির ১৪ শতাংশ নাগরিককে সোমবার নাগাদ টিকা দেওয়া হয়েছে। আরব ও তেল আবিব গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে বিশ্বে টিকা দেওয়ার হার ইসরায়েলে সব থেকে বেশি। অথচ ফিলিস্তিনিদের টিকা দেবে না ইসরায়েল।

জেরুজালেম পোস্টের হিসাব অনুসারে, ইসরায়েল ১ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে। ৮০ লাখ ইসরায়েলিকে টিকা দেওয়া হবে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের টিকার আওতায় আনা হবে না। ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীরে বেছে বেছে ইহুদি অভিবাসীদের টিকা দিচ্ছে। এমনকি জেলখানাগুলোতে নিরাপত্তাকর্মী ও ইহুদি কয়েদিদের টিকা দেওয়া হলেও আটককৃত ফিলিস্তিনিদের টিকা দেওয়া হয়নি।

ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীরে বেছে বেছে ইহুদি অভিবাসীদের টিকা দিচ্ছে। এমনকি জেলখানাগুলোতে নিরাপত্তাকর্মী ও ইহুদি কয়েদিদের টিকা দেওয়া হলেও আটককৃত ফিলিস্তিনিদের টিকা দেওয়া হয়নি। ইসরায়েলের এ ধরনের আচরণকে মানবাধিকারকর্মীরা পরিষ্কারভাবে বর্ণবাদী বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন মেডিকেল বর্ণবাদ

ইসরায়েলের এ ধরনের আচরণকে মানবাধিকারকর্মীরা পরিষ্কারভাবে বর্ণবাদী বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন মেডিকেল বর্ণবাদ। ইসরায়েলের বর্ণবাদী আচরণ গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের চরম এক মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। মানবিক সংকট ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে সংকট নিয়েই তারা বেঁচে আছে। কোভিড-১৯ মহামারি তাদের জন্য নতুন আরেক সংকটের সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যেই গাজা ও পশ্চিম তীরে ১ হাজার ৫০০ মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

বিশ্বের সব থেকে সুরক্ষিত রাষ্ট্র ইসরায়েল। আর সব থেকে ভয়ে থাকে এই রাষ্ট্রের নাগরিকেরাই। তাই ইসরায়েলের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, মহামারিতে আক্রান্ত করে ফিলিস্তিনিদের যতটা সম্ভব মেরে ফেলা যায়। তাদের বাধা পেরিয়ে গাজা ও পশ্চিম তীরে টিকা পৌঁছানো অসম্ভবও বটে। কারণ, পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অন্য কোনো দেশ গাজা বা পশ্চিম তীরের অধিবাসীদের টিকা দিতে চাইলেও ইসরায়েলের অজ্ঞাতে দিতে হবে অথবা ইসরায়েলের মাধ্যমে দিতে হবে।

এ ছাড়া টিকা সংগ্রহ করে সংরক্ষণের মতো অবকাঠামোও গাজা বা পশ্চিম তীরে কিছুই টিকিয়ে রাখেনি ইসরায়েল। গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যসেবা দিলেও কোভিড-১৯-এর টিকা সংরক্ষণের মতো সুবিধা নেই। যেমন ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা শূন্যের নিচে ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে সংরক্ষণ করতে হয়। গাজায় মাত্র ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা আছে। ২০১৪ সালে গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ইসরায়েল বোমা হামলায় ধ্বংস করে দেয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরায়েলের এ নীতিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ বলে মন্তব্য করেছে। কথায় আছে খলের ছলের অভাব হয় না। ইসরায়েলের ওজর-আপত্তির অভাব নেই। অসলো চুক্তির কথা বলে অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাঁরা। অসলো চুক্তিতে গাজা ও পশ্চিম তীরের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। আর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের পক্ষে সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভবও না। পশ্চিম তীরের ৩৮ শতাংশ এলাকা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অধীনে আছে। ৬২ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। পশ্চিম তীরে ৩১ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করে। ২১ লাখ বাস করে গাজায়। মোট ৫২ লাখ ফিলিস্তিনি এখন ইসরায়েলের টিকা জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদের শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি দখলে নেওয়া, হামলা করা, হত্যা করা সব নিয়মসিদ্ধই করে নিয়েছে। ইসরায়েলের দখল-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না। বললেই ইসরায়েল ‘অ্যান্টি সেমেটিক’ তকমা লাগিয়ে দেবে। এমনকি অ্যান্টি সেমেটিক উল্লেখ করে গেল বছরের নভেম্বরে ডারবানে বর্ণবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনুদান না দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিল ইসরায়েল। ওই সম্মেলনে ইসরায়েলের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেছিল প্রতিবাদী অংশগ্রহণকারীরা।

সার্বিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা বৈশ্বিক অসাম্য ও বর্ণবাদকে নতুনে সামনে তুলে এনেছে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের টিকার সংকট একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের উদাহরণ ভূরি ভূরি পাওয়া যাচ্ছে। টিকা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে। নিম্নমানের টিকা গছিয়ে দিচ্ছে বেশি দামে। বিভিন্ন দেশের প্রধানেরা প্রকাশ্যে টিকা গ্রহণের ছবি দিয়ে নিজেদের টিকার বিজ্ঞাপন করছেন।

একই সঙ্গে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ধনী ও শক্তিশালী দেশের প্রয়োজনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি টিকা কিনে মজুত করে রাখছে। এসব দেশের চাহিদা মিটিয়ে ফিলিস্তিনের মতো দখল হয়ে যাওয়া বা গরিব দেশগুলো আদৌ টিকা পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ ২০২২ সালের আগে টিকা না-ও পেতে পারে, যদি জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের হিসাব মতে, ধনী দেশগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫৩ শতাংশ টিকা অগ্রিম কিনে ফেলেছে। এই দেশগুলোতে বিশ্বের মাত্র ১৪ শতাংশ জনসংখ্যা বসবাস করছে।

ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের হিসাব মতে, ধনী দেশগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫৩ শতাংশ টিকা অগ্রিম কিনে ফেলেছে। এই দেশগুলোতে বিশ্বের মাত্র ১৪ শতাংশ জনসংখ্যা বসবাস করছে। ক্ষমতাধর দেশগুলোর টিকা জাতীয়তাবাদ বিশ্বকে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নিয়ে যাচ্ছে। তাদের আচরণ ও নীতি কোভিড-১৯ থেকে কোনো অংশেই কম ধ্বংসাত্মক নয়।

ক্ষমতাধর দেশগুলোর টিকা জাতীয়তাবাদ বিশ্বকে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নিয়ে যাচ্ছে। তাদের আচরণ ও নীতি কোভিড-১৯ থেকে কোনো অংশেই কম ধ্বংসাত্মক নয়। এই অবস্থার অবসান ঘটানো জরুরি। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধকে কে? ফিলিস্তিনের মজলুমের পক্ষে কথা বলে যেমন কেউ অ্যান্টি সেমেটিক হতে চায় না। এসব রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ বিপাকে পড়তে চায় না। পৃথিবীতে এখন লোকরঞ্জনবাদী নেতার অভাব নেই। কিন্তু মানবতাবাদী নেতৃত্বের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।

তাই ফিলিস্তিনিরা ধুঁকছে। বোমা হামলায় ফিলিস্তিনি যুবকের দেহ শতচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইসরায়েলি পুলিশের গুলিতে চোখের আলো হারিয়ে যায় ১৬ বছরের বাসার হামাদের। মাথার খুলি ফেটে যায় ইউসুফ তাহার। হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওরা দেখে শুধু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলাই নয়, বুকে চেপে বসে আছে কোভিড-১৯ মহামারিও। ওদের বাড়ির অধিকার নেই, জমির অধিকার নেই, টিকার অধিকার নেই। ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্ররা নিজভূমেই অভিবাসী। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির ওদের আশ্রয়। আর দখলদার ইসরায়েলিরাই ঠিক করে দেয় কে টিকা পাবে আর কে পাবে না। হামলা, দখল ছাড়াও টিকা জাতীয়তাবাদের নির্মম শিকার ফিলিস্তিনিরা।


ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক