ঈদ, বেকার ও লিবিয়ার রেডক্রস ক্যাম্পে থাকা তরুণেরা

করোনা সবচেয়ে বিপদে ফেলেছে বেকারদের
ছবি: প্রথম আলো

পৃথিবীতে যত দুঃখী মানুষ আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃখী হলো বেকারেরা। তাঁরা শিক্ষাজীবন পার করে এসেছেন। অথচ কর্মজীবনে ঢুকতে পারছেন না। শিক্ষার্থী থাকতে তাঁরা বাবার হোটেলে খেতেন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর তা আর সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে এমন কম মা-বাবা আছেন, যাঁরা লেখাপড়া শেষ হওয়ার পরও সন্তানের খরচ জোগাতে পারেন। করোনার আগে বেকার নামক ট্রানজিট ক্যাম্পের বাসিন্দারা টিউশনি করে, টুকটাক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চাকরির জন্য একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিতেন। বাড়িতে মা-বাবাকে জানিয়ে দিতেন, কষ্টের দিন আর থাকবে না। তিন মাস, ছয় মাস পর একটা কিছু হয়ে যাবে।

করোনাকালে সেই সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ। মেসের ভাড়া বাকি পড়ায় অনেক বাসিন্দা বাড়ি চলে গেছেন। তারপরও যাঁরা মাটি কামড়ে ছিলেন, তাঁদের পুঁজিপাট্টাও শেষ। কেউ কেউ ধারকর্জ করে, বন্ধুদের মেসে থেকে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চাকরির বাজার একেবারেই ফকফকে। সরকারি দপ্তরে দু-চারটি পদে যদিও-বা লোক নেয়, মামার বা টাকার জোর না থাকলে কাজ হবে না। অনেক চাকরিপ্রার্থী ইন্টারভিউ দিয়ে এসে বলেন, ইন্টারভিউ তো ভালো হয়েছে। কিন্তু চাকরি হবে না। তাঁরা কাকে নেবেন, আগেই ঠিক করে রেখেছেন। ইন্টারভিউ হলো নিয়মরক্ষা। আগে চাকরিদাতা মামারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিলেন। এ দলের মামাকে দিয়ে না হলে ও দলের মামার কাছে যাওয়া যেত। এখন সব মামা এক দলের। সব জোরও এক দলের।

করোনা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেই বিপদে ফেলেছে। সবার আয় কমে গেছে। তবে বেশি বিপদে ফেলেছে বেকারদের। দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করেন। সরকারি-বেসরকারি মিলে কাজের সুযোগ আছে খুব বেশি হলে ছয় থেকে সাত লাখের। বাকিরা কোথায় যাবেন? যাঁরা লেখাপড়ার তেমন তেমন পাননি, তাঁদের কেউ গ্রাম থেকে শহরে এসে রিকশা চালান, কেউ বড়লোকের প্রাসাদ বানানো কিংবা সেই প্রাসাদ পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হন, পুলিশের লাথি-গুঁতো খেয়ে বখরা দিয়ে ফুটপাতে হকারি করেন। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি যাঁদের আছে, তাঁরা তো এসব কাজ করতে পারেন না। এ কারণে হয় তাঁরা আদম ব্যাপারীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মরেন কিংবা রেডক্রসের ক্যাম্পে ঠাঁই নেন। কারও কারও ঠিকানা হয় বিদেশের কারাগার। আর যাঁরা দেশে থাকেন, তাঁদের একাংশ সরকারি দলে ভিড়ে গিয়ে ফাও কামিয়ে নেন। নেতা বা উপাচার্যের বদৌলতে তৃতীয় শ্রেণির একটি চাকরি পেয়ে আহ্লাদিত হন।

কিন্তু এর বাইরে লাখ লাখ তরুণ বেকারই থেকে যান। ২০১৪ সালে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের হিসাবে বাংলাদেশ ছিল সর্বাধিক শিক্ষিত বেকারদের দেশ। করোনাকালে দেড় বছর প্রায় সব নিয়োগ বন্ধ থাকার পর বেকার আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ঘরে ঘরে তরুণদের চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিল। এখন ঘরে ঘরে বেকার। অর্ধবেকার, ছদ্মবেকার।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ মানবসম্পদ করে না; স্থায়ী বেকার তৈরি করে। করপোরেট হাউস, আইটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি হাসপাতালের মতো সেবাপ্রতিষ্ঠানেও যেসব দক্ষ কর্মী দরকার, আমাদের শিক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার জোগান দিতে পারে না। এ কারণে দেশের শিক্ষিত যুবকেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, আর অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়ে আসে তাদের প্রয়োজনে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি—সব ক্ষেত্রে উল্টো নীতি। আমরা মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলি; কাজ করি ঠিক তার উল্টো।

এখনো সরকারি চাকরির প্রধান আকর্ষণ বিসিএস বা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। কিন্তু বিসিএসে প্রতিবছর ক্যাডার, নন-ক্যাডার মিলে ছয় হাজার লোক নেওয়া হয়। পরীক্ষা দেন লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। এক বছর ধরে সেই বিসিএস পরীক্ষাও বন্ধ। পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ করা হচ্ছে না। ফল প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ আটকে আছে। ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল চার মাস আগে। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ফলাফল আটকে আছে। পিএসসি বলেছে, ঈদের পর বিধিনিষেধ শিথিল হলে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। প্রিলিমিনারির পর লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষার পর চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা। স্বাভাবিক সময়েই ১৫ থেকে ১৮ মাস লেগে যেত। করোনাকাল কবে পরীক্ষা শুরু ও শেষ হবে কেউ বলতে পারছেন না। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, যথাসময়ে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরা। তাঁরা জানান, এই চাকরির পরীক্ষার ফল সঠিক সময়ে প্রকাশ না হওয়ায় তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফল প্রকাশের পর তাঁরা জানতে পারতেন, লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নেবেন। সামনে সেই লক্ষ্য না থাকায় লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে পারছেন না।

সরকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু বেকারদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। বেকারেরাও যে এ দেশের নাগরিক, সে কথা হয়তো সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভুলেই গেছেন।

এত সব হতাশার মধ্যে শিক্ষক পদপ্রার্থীদের জন্য একটি সুখবর আছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষক পদে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের নিয়োগে সুপারিশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। গত শনিবার থেকে আইসিটি শিক্ষক পদে নির্বাচিত ১৫তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মোট ৫১ হাজার ৭৬১টি পদের বিপরীতে প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়েছে।

মোবাইলে এসএমএস পাওয়ার পাশাপাশি এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটেও ফল পাওয়া যাবে। প্রার্থীরা নির্ধারিত লিংকে প্রবেশ করে (http://103.230.104.210:8088/ntrca/c3/app/) ফলাফল দেখতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের লিংকে প্রবেশ করে e-Results (Public Circular: 2021-03-30) বাটনে ক্লিক করতে হবে। সেখানে e-Results for Applicant View বাটনে ক্লিক করে নিবন্ধন ব্যাচের নম্বর ও রোল নম্বর বসিয়ে Find বাটন ক্লিক করে সুপারিশ পেয়েছেন কি না, তা দেখতে পারবেন।

সরকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু বেকারদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। বেকারেরাও যে এ দেশের নাগরিক, সে কথা হয়তো সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভুলেই গেছেন। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। কিন্তু করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোনো পরীক্ষা হতে পারেনি। এ কারণে তাঁরা দেড় থেকে দুই বছর পিছিয়ে গেছেন। তাই চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর যে দাবি উঠেছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই মনে করি। আগে থেকে তরুণদের একাংশ চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলন করে এসেছিলেন। এই তরুণেরা স্পিকার-মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। আদালতে রিট করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সরকার তখন বলেছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেশনজট কমেছে। এ কারণে বয়সসীমা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। আসলেই কি সেশনজট কমেছে? কমেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় গড়ে দুই বছর সেশনজট লেগে আছে। কোনো বিষয়ে আরও বেশি।

ঈদ মানে খুশি। করোনার সংক্রমণের মধ্যেও সবাই চেষ্টা করবেন নিজ নিজ সামর্থ্যের মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে। কিন্তু বাংলাদেশে যে লাখ লাখ বেকার আছে—যাঁরা বেকারত্বের কারণে নিজের পরিবার-পরিজন থেকেও পালিয়ে থাকেন, হররোজ রোজা থাকেন—তাঁদের জীবনে এ ঈদ কোনো আনন্দ নিয়ে আসবে না। আনন্দ নিয়ে আসবে না, যাঁরা ভাগ্যের সন্ধানে গিয়ে লিবিয়ায় রেডক্রসের আশ্রয়শিবিরে আছেন।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব দুঃখী মানুষকে সহায়তা তো দূরের কথা, একটু সহানুভূতি প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি। কেননা, বেকারেরা তো মানুষ নন, কেবলই সংখ্যা।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।