ঈদের হরষ যেন বিষাদে ঢেকে না যায়

ফাইল ছবি

চোখ বুজলেই সেই ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠছে, ফেরি থেকে সবাই নেমে যাওয়ার পর ছেলেটি দেখে তাঁর মা যাত্রীদের পায়ে দলিত হয়ে মারা গেছেন। ঈদ, মা, বাড়ি—এগুলো যে সব এক শব্দ, একাত্তরে মা-ছাড়া ঈদ এলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। নয় মাসের মধ্যে সেদিনই বোধ হয় প্রথম কেঁদেছিলাম। মাকে ছাড়া ঈদ! মা কিন্তু তখনো বেঁচে। দেশ স্বাধীন হলে আমি বেঁচে থাকলে দেখা হওয়ার সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের সেই কান্না এখনো কাঁদায়। আমি দেশ পেয়েছিলাম, মাকেও পেয়েছিলাম জীবন্ত (যদিও একাত্তরের ধকল সামলাতে না পেরে চুয়াত্তরের জুনেই তিনি চলে যান)।

কিন্তু এই বালকটি কোন দেশে কী নিয়ে বাঁচবে? নদী দেখলেই যার মনে হবে, এই রকম এক নদী পেরোতে গিয়ে তার মা শেষ হয়ে যায়। ফেরি দেখলেই যাকে কাঁদতে হবে মায়ের জন্য; ভিড় দেখলে, কোতোয়ালদের দেখলে, সাংবাদিক দেখলে, ম্যাজিস্ট্রেট দেখলে যার শুধু মায়ের থেঁতলে যাওয়া মুখটাই মনে পড়বে! কোন জীবন সে কাটাবে রক্তে ‘স্বাধীন’ বাংলাদেশে? এ প্রশ্নের উত্তর চাইলে কোতোয়ালদের পক্ষ নিয়ে কেউ বলবেন, ‘যায় কেন? এত বাধা দেওয়ার পরও কথা শুনে না কেন?’ এসব প্রশ্ন নিয়ে বাহাসের জন্য এই লেখা নয়, এই লেখা ঈদের দিনে তার পরের দিনে, ছুটির এই কটা দিনে একটু সাবধানে থাকার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শিশু-কিশোরের মৃত্যু বাড়ে


২০২০-এর ঈদের দিনের দুর্ঘটনার ৩৩ ভাগই ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। নিহত হন ২৯ জন। চিরতরে পঙ্গু ৫৮০ জন। সবাই কিশোর-তরুণ। দেশের বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ক্রীড়াবিদ এবং সমাজসেবক ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘মোটরসাইকেল হাতে পেলেই কিশোর, তরুণেরা গতির নেশায় দিশেহারা হয়ে যায়।

আর ঈদে “ফুর্তি” করতে কাঁচা হাতে চালাতে গিয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছে নয়তো নিহত হয়ে পত্রিকার খবর হচ্ছে। অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, পরে সারা জীবনের কান্নার চেয়ে এখনই আপনার পুত্রকে নিয়ন্ত্রণ করুন।’

আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যাত্রীকল্যাণ সমিতি সারা দেশের হিসাব তুলে ধরে জানিয়েছিল, সে বছর ঈদ মৌসুমে মোট ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৭৬টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। তার আগের বছর (২০১৮) সালে একই সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২০১৯-এর প্রায় অর্ধেক। ২০১৯-এর ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেলের আরোহী।

ঈদের দুর্ঘটনার সব পরিসংখ্যান কখনো কেউ জানতে পারে না। কেবল বড় দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর খবরই চাউর হয়। মৃত্যুর খবরের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলো নথিভুক্ত হয় না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। গত বছর ঈদের দিন প্রথম ছয় ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিশোরের সংখ্যা ছিল ২৭। আরও ৪টা জেলা শহরের তথ্য প্রায় একই রকম ছিল। গত বছর এমন কোনো জেলা পাওয়া যায়নি, যেখানে ঈদের তিন দিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কোনো কিশোর বা তরুণের মৃত্যু হয়নি।

গত বছর (২০২০) ঈদের দিন বিকেল গড়ানোর আগেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯ শিশু-কিশোর-তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা ও পিরোজপুরে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাজশাহী ও ময়মনসিংহে দুজন করে এবং অন্য পাঁচ জেলায় একজন করে মারা যান। তাঁদের সবাই বাইকে আরোহী ছিলেন। প্রায় সবাই ঈদের দিন আনন্দভ্রমণ করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন।

নিহত লোকজনের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী ছিল ১০ বছরের সাইফুল ইসলাম হৃদয়। ঈদের দিন (২৫ মে ২০২০) বিকেলে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চৌঠাইমহল বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় হৃদয়। ঈদের আনন্দ ‘উপভোগ’ করতে বিকেলে কয়েকজন বন্ধু মিলে পৃথক মোটরসাইকেলে করে ঘুরছিল হৃদয়। এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল রাস্তার পাশের একটি গাছে ধাক্কা লাগে। ওই মোটরসাইকেলে থাকা হৃদয় মাথায় আঘাত পায়। আহত হৃদয়কে নাজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঈদের দুর্ঘটনার সব পরিসংখ্যান কখনো কেউ জানতে পারে না। কেবল বড় দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর খবরই চাউর হয়। মৃত্যুর খবরের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলো নথিভুক্ত হয় না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। গত বছর ঈদের দিন প্রথম ছয় ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিশোরের সংখ্যা ছিল ২৭।

মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়ে ১৮ বছরের রিয়াদ প্রায় একই সময়ে নিহত হন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুরে। জেলার বাগমারা উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়ে নিহত হন মেহরাব (১৯) ও তাঁর সহযাত্রী মিজান (২০)। বলা বাহুল্য, এসব আচমকা মৃত্যুতে মুহূর্তের মধ্যে আনন্দের ঈদ তাঁদের পরিবারে বিষাদে পরিণত হয়। আর এই বিষাদ পরবর্তী ঈদে-পার্বণে-উৎসবে বারবার ফিরে ফিরে আসে।

মজার ব্যাপার, বাংলাদেশে আলু-পটোল, পেঁয়াজ-মরিচ, গরু-খাসি-ব্রয়লারের দাম বাড়লেও মোটরসাইকেলের দাম কমে। ঈদে উৎসবে ছাড়ের ওপর ছাড় চলতে থাকে বেশুমার। বিজ্ঞাপনে মন খারাপ কিশোরের মান ভাঙাতে মোটরসাইকেল দিয়ে চমকে দেওয়ার গল্প দেখানো হয়। প্রচারিত হয় না সংবিধিবদ্ধ কোনো বাণী, থাকে না গতিসীমার কথা, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সের কথা, দুজনের বেশি না চড়ার কথা, সব সময় হেলমেট ব্যবহারের কথা।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের নেতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের মতে, শুধু রাজধানীতেই আছে ৩০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী (৩০ জানুয়ারি, ২০২০), ২০১৮ ও ২০১৯—এই দুই বছরে নতুন মোটরসাইকেল বিক্রির সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। মেরামতি, সেকেন্ডহ্যান্ড, গলাকাটা, ইত্যাদি এসব হিসাবের বাইরে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়।

ফলে, কোম্পানিগুলো বাজারে মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ পায়। পরের তিন বছর তরতর করে বাজার বাড়তে থাকে। বাজার আরও বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা এখন দাবি তুলছেন, মোটরসাইকেল কিনতে ব্যাংকঋণের সুযোগ দিতে হবে। বলছেন, লাইসেন্সের শর্ত ঠিক আছে, কিন্তু আমরা চালানো শিখিয়ে লাইসেন্স দিলে ক্ষতি কী? চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দিতে বেসরকারি খাতকে সুযোগ দেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা। বাজারের চাঙাভাব ধরে রাখতে থাইল্যান্ডের বড় কোম্পানিগুলো সরকারের পক্ষে নিজেরাই নাকি লাইসেন্স দেয়। থাইল্যান্ডে অবশ্য অনেক কিছুই হয়। যার যেটা পছন্দ, সে সেটার পক্ষে ওকালতি করবেই।

দেশে যত শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, তার ৩৫% ঘটে ঈদের বা বড় ছুটিতে

দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটে পানিতে ডুবে। গত ঈদের ছুটিতে গাজীপুর, ফেনীর ছাগলনাইয়া, যশোরের বেনাপোল, বরিশাল, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে পৃথক ঘটনায় ৩ দিনে পানিতে ডুবে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত লোকজনের বেশির ভাগ শিশু। তারা খেলার সময় অথবা গোসল করতে নেমে পানিতে ডুবে যায়। নৌকাডুবিতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া বরিশাল বিএম কলেজ ও নটর ডেম কলেজের দুই ছাত্রও পানিতে ডুবে মারা যান। শিশুমৃত্যুর ঘটনা ছুটিতে বাড়ে। একে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে ডুবে যায় সকলে। ১০টা থেকে ২টার মধ্যে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

পানিতে ডুবে মৃত্যু
প্রতীকী ছবি

এখন পর্যন্ত শিশুদের জলে ডুবে মৃত্যু নিয়ে যা ছিটেফোঁটা গবেষণা হয়েছে, তাতে কতগুলো বিষয় পরিষ্কার: সারা বছর যত শিশু জলে ডুবে মারা যায়, তার কমপক্ষে প্রায় ৩৫ শতাংশ মারা যায় বিভিন্ন লম্বা ছুটির সময়—পালা, পার্বণ, উৎসব, আনন্দের দিনে।

এ ছুটি রাষ্ট্রীয় হতে পারে বা একান্ত পারিবারিক উপলক্ষে ছুটি। দেশ-গ্রামের বিস্তৃত পরিসরে আরও অনেক সমবয়সী ভাইবোন, চেনাজানাদের নিয়ে বেড়াতে আসা শহরবন্দী শিশুটির চেখে দেখার পরিসর বেড়ে যায়। সে উচ্ছল হয়ে ওঠে। নতুন জিনিস দেখার, নতুন কিছু করার আগ্রহে ছুটে যায় নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয়ের কাছে। এদের মধ্যে সাঁতার জানা দু-একজন হয়তো বীরত্ব দেখাতে ঝাঁপ দেয় জলে। শহরের শিশুটি বা বেড়াতে আসা ক্ষণিকের শাসনমুক্ত শিশুটিও ভাবে, ও পারলে আমিও পারি। ঝাঁপ দেয় সাঁতার না-জানা শিশুটিও। তাকে খাবি খেতে দেখে কেউ ভাবে অভিনয়, আবার কেউ ভাবে টেনে তুলি। সাঁতার জানা আর ডুবন্ত মানুষকে টেনে তোলা এক নয়। একসঙ্গে দুই ভাইবোন বা একাধিক জ্ঞাতি ভাইবোন ডুবে যাওয়ার মর্মান্তিক খবর এভাবেই তৈরি হয়।

গবেষকেরা তত্ত্ব-তালাশ করে আরও কিছু কৌতূহল জাগানিয়া সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। যেমন এসব শিশু মা বা তত্ত্বাবধায়কের ১০০ গজ দূরত্বের মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে, অর্থাৎ মায়েরা যখন ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত থাকছেন। বেশির ভাগেরই বয়স চার বছরের নিচে।

তবে যেখানে একসঙ্গে দু-তিনজন বা তার বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, সেখানে পাঁচের বেশি বয়সী শিশুরাও আছে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে একটু বড় শিশুরা উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেরাও মারা যাচ্ছে।

মাদককে না বলুন

ঈদে মদপান করে মৃত্যু

নববর্ষ উদযাপন, বিয়ের অনুষ্ঠানের বাইরে এখন ঈদ উপলক্ষে মদপানের নতুন হিড়িক দেখা যাচ্ছে। গত বছর রংপুরের পীরগঞ্জে ঈদ উপলক্ষে নেশাজাতীয় বিষাক্ত মদপানে পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন আরও প্রায় ৮ থেকে ১০ জন। বিভিন্ন বয়সের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে পীরগঞ্জের শানেরহাট বন্দরে সোমবার রাতে মদপান করে ঈদ উদ্‌যাপন করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। এতে ওই দিন রাত থেকেই অন্তত ১৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাধারণত সামাজিক কারণে মদপানে কেউ মারা গেলে অনেক সময় অভিযোগ দেয় না। বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশের পক্ষে অননুমোদিত মদের উৎস অনুসন্ধান করার জন্য কোনো চাপ থাকে না।

মদপানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু বা অন্ধত্ব ঠেকানো যাক না যাক, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হৃদয়দের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। সম্ভব শিশুর পানিতে ডোবার হার শূন্যতে নামিয়ে আনা। শিশু-কিশোরদের রক্ষার দায়িত্ব মা-বাবাসহ পরিবারের। তাঁদেরই এই দায়িত্ব নিতে হবে। ঈদের হরষ হরষেই শেষ হোক, বিষাদে নয়।

* গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, গবেষক
nayeem 5508 @gmail. com