উচ্চশিক্ষা: মনসার দুনিয়ায় সংশপ্তকদের লড়াই

পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন কেন এমন শিরোনাম? ব্যাখ্যায় পরে আসছি। আগে চলুন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার সারসংক্ষেপ শুনি।
১. খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ‘পরিবারের’ লোকজন নিয়োগ। অন্য দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডি ডিগ্রিধারী (তার কয়েকটি আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত) বাদ দিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের নিয়োগ।
২. হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে নম্বরপত্র ঘষামাজা করে কয়েক বছরে অন্তত ১৪ জন শিক্ষক নিয়োগ।
৩. দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের লুকিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ।
৪. মেয়াদপূর্তির শেষ সময়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত তিন শিক্ষককে স্থায়ী বরখাস্ত করলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির ২০১৯ প্রতিবেদন: প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক এনজিও ব্যবসা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকসহ অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকের বিতর্কিত কার্যকলাপের খবর গণমাধ্যমে সম্প্রতি এভাবেই এসেছে।  উচ্চশিক্ষার এই অবনমন এক দিনে হয়নি বা ভিনগ্রহের কেউ এসেও করেনি। এই অবস্থার জন্য আমরা সব সময় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিকে দায়ী করি। কিন্তু এটাই কী একমাত্র কারণ? চলুন দেখা যাক।

উচ্চশিক্ষায় সংশ্লিষ্টদের মোটাদাগে দুভাগে ভাগ করা যায়, ‘সংশপ্তক’ আর ‘রাজনীতিবিদ’ শিক্ষক। বিয়োগান্তক পরিণতি জেনেও সংশপ্তক শিক্ষকেরা সব সময় লড়াই করেন। তাঁদের যুদ্ধ এখনো দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভাগের দু-চারজন শিক্ষককে দেখেছি রাজনীতিতে, কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষকসমাজ, ছাত্রছাত্রী তথা দেশের কল্যাণ। পেশাগত কাজ ঠিক রেখে তাঁরা রাজনীতি করতেন।
কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাটাই থাকে রাজনীতিবিদ শিক্ষকদের হাতে, যাঁদের আচরণ প্রায় সব ক্ষেত্রে বেহুলা-লখিন্দর গল্পের ‘মনসা’র মতো।

বারবার অনুরোধ করেও পূজা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে চাঁদ সওদাগরের সব ছেলেকে দংশন করেন মনসা । থাকে শুধু একটা ছেলে-লখিন্দর। ব্যাপক নিরাপত্তা নেওয়ার পরও বাসর রাতে সুতার মতো সাপের আকার ধারণ করে এই লখিন্দরকেও দংশন করে মনসা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাঁরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত, নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে প্রায়ই তাঁরা এই ‘মনসা’ চরিত্রে অবতীর্ণ হন। নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতার জন্য আশপাশে রাখেন লখিন্দরের মা ‘সনকা’র মতো কিছু মানুষ। বলা বাহুল্য, সনকা ছিলেন মনসা ভক্ত। তাঁদের এই ভক্তকুল সংশপ্তকদের সম্পর্কে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে কাজের পরিবেশকে করে বিষাক্ত। শেষাংশে ইজ্জতের ভয়ে পিছু হটেন সংশপ্তকেরা, জয়ী হয় ‘মনসা’রা ।

রাজনীতিবিদ শিক্ষকেরা দিনের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেন ভোটারদের মন জয়ের কাজে। পেশাগত দায়িত্ব পালন না করলে কীই-বা আসে যায়! প্রয়াত এক উপাচার্য ডিন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন নিয়োগ বোর্ডে বসতেন আর নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্মতারিখ ডায়েরিতে টুকে রাখতেন। যথাসময়ে শুভেচ্ছা ও উপহার পাঠাতেন, যাতে নির্বাচনে ভোট পাওয়া যায়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিসীমানায় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা (ভোটের ভিত্তিতে) প্রমাণ করতে পারলে ধরা যায় অদূর ভবিষ্যতে বড় পদ-পদবি পাবেন তিনি । দৈবাৎ বা পছন্দক্রমে একবার কর্তা বনে গেলেই শুরু হয় পরিবার, স্বজন বা এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থান। এতে লাভ দুটি। প্রথমত, তুলনামূলকভাবে অমেধাবীদের ‘পুনর্বাসন’ করতে পারলে গুণকীর্তন হয়, চাহিদার অতিরিক্ত হিসাবে পাওয়া যায় ‘সনকা’র মতো অনুসারী। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিকতা/স্বজনদের তোষণে আরও বড় বা জনপ্রতিনিধির মতো পদ বাগানো যায়।

ওপরের উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার যে দৈবাৎ/পছন্দক্রমে নিয়োগ পাওয়া লোকজন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে সব সময় ব্যস্ত, যার মাশুল গোটা জাতিকে দিতে হচ্ছে বা হবে যুগের পর যুগ। আর রাজনৈতিক রং ব্যবহার করলে উদ্দেশ্য হাসিল পানির মতো সহজ। সংশপ্তকদের সংখ্যা বেশি, নৈতিকতাও দৃঢ়, তবে ক্ষমতা কম। পক্ষান্তরে, ‘মনসা’দের সংখ্যা কম, নৈতিকতা দুর্বল; কিন্তু ক্ষমতা অপরিসীম। মেধাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারে তাঁরা খুবই পটু। আর তাই রাজনীতির মারপ্যাঁচে সংশপ্তকেরা দিনের পর দিন প্রতিবাদ করলেও শোনার মানুষ কম। বর্তমান ব্যবস্থায় তাঁদের যৎসামান্যই করার আছে।

আমরা কখনো প্রশ্ন করি না শিক্ষকদের মধ্যে অপরাজনীতি কে ঢোকাল, হেতু কী, কার ক্ষতি, কার লাভ, শুধু চাঁদ সওদাগরের স্ত্রীর মতো অনুসরণ করে যাই। ফলে উচ্চশিক্ষার হাল দিন দিন ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারের মতো ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের যেমন আনন্দ দিচ্ছে না, তেমনি তৈরি হচ্ছে না নৈতিকতাসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ।

ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ধরুন, একটি পরিবারে আটজন ভাইবোনের মধ্যে এক-দুজন শিক্ষিত আর বাকিরা মূর্খ। এই অবস্থায় ওই পরিবারের সামগ্রিক উন্নতি কখনোই সম্ভব না। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার আধুনিকায়ন ও তথাকথিতদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রানা প্লাজার মতো দুর্বল ভিত দিয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করা হবে দুঃসাধ্য ও দুরূহ।

আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস এর গবেষক।