উপাচার্যের পদত্যাগই একমাত্র সমাধান

নিজের কক্ষে অবরুদ্ধ উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন
নিজের কক্ষে অবরুদ্ধ উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন

২১ আগস্ট দুপুর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রয়েছেন। শিক্ষক সমিতি কর্তৃক ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষিত উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ফোরাম উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেছে। পদত্যাগ না করার ব্যাপারে এখনো তিনি অনড় এবং সংকট নিরসনে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি ও মহামান্য আচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। আমরা মনে করি, যে উপাচার্য সংকট নিরসনে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে আচার্যের দ্বারস্থ হন, তাঁর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা আর সম্ভব না। আমরা সরকার ও আচার্যকে অতি দ্রুত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্যের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষার অনুরোধ জানাই।
গত ১৯ জুন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় উপাচার্য আনোয়ার হোসেনকে ক্যাম্পাসে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করা হয়। পদত্যাগের এই দাবিটিকে উপাচার্য ‘কিছুসংখ্যক শিক্ষকের দাবি’ উল্লেখ করে জাতির কাছে সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় শতাধিক শিক্ষক রয়েছেন। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি এবং ক্যাম্পাসে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় গৃহীত হয়েছে। শিক্ষক সমিতির চলমান আন্দোলনকালে বিভিন্ন পদ-পদবির আশায় শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের পক্ষাবলম্বন করে শিক্ষক সমিতির আন্দোলন প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এর আগে শিক্ষক সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে আবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনুরোধে সরে এসেছেন বলে প্রচার করছেন। প্রকৃতপক্ষে, এ তথ্য সত্য নয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় শ শিক্ষকের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থী পাঁচজন এবং বাম ঘরানার ১২ জন শিক্ষক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবি করে আসছেন। সরকার ইচ্ছে করলেই এ তথ্যের ভিত্তি যাচাই করতে পারে।
শিক্ষক সমিতি কর্তৃক ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে প্রচারিত ব্যানারে লেখা ‘অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী এবং মিথ্যুক উপাচার্য ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত’ অশিষ্ট শব্দগুলো ব্যবহারে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। এ শব্দ ব্যবহারে আমরাও লজ্জিত। কিন্তু বাস্তবতা বোঝাতে এ শব্দগুলো ব্যবহারের বিকল্প ছিল না। প্রকৃত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে চেনাতে এ শব্দগুলো খুব যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবসম্মত। শিক্ষক হিসেবে আমরাও ব্যথিত হই, যখন দেখি উপাচার্য আনোয়ার হোসেন একের পর এক মিথ্যা কথা বলেন। এ কারণে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বক্তব্য আমাদের রেকর্ড করতে হয় এবং এটা তাঁকে জানিয়েই করা হয়। এটা কি আমাদের জন্য কম কষ্টের?
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে যিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, এখন তিনি বাংলাদেশ কর্মকমিশনের সদস্য। ওই উপাচার্যের অনুসারীরা বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ওই উপাচার্যকে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সাধারণ সম্পাদক সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিনকে ‘বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ’ বলে গালি দেন। অধ্যাপক খবীর উদ্দিন শিক্ষক রাজনীতিতে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর এ গালি দেওয়ার রেকর্ড আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি ব্যবহার করা ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তাভাবনা আমরা লক্ষ করিনি। তিনি পুকুর-জলাশয় পুনঃখনন করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির দাবি করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু পর্যটনকেন্দ্র না, সে জন্য এসব কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রগতি বলে বিবেচিত হয় না। একজন উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার যে নিরন্তর প্রচেষ্টা গ্রহণ করার কথা, তা গ্রহণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। উপাচার্য নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষীয় সভা যেমন সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং অন্যান্য শিক্ষা-গবেষণা সংশ্লিষ্ট পর্ষদের সভা আয়োজনে তাঁর মনোযোগ নেই। একাডেমিক গতিশীলতা তাঁর সময়ে সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর ‘শো ম্যানশিপ’ মানসিকতা থেকে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে অনুৎপাদনশীল খাতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি ব্যবহার করে শুধু নিজেকে ঋদ্ধ করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে তিনি কোনো কিছু করেননি।
উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধায় অনিয়ম করেছেন। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ঢাকায় চাকরি করেন। তাঁরা ক্যাম্পাস থেকে যাওয়া-আসা করেন। উপাচার্য হিসেবে সরকারিভাবে তাঁর জন্য গাড়ি বরাদ্দ একটি। কিন্তু এখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহারে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করছেন।
এ কথা সত্য, দেশে বর্তমানে একমাত্র আনোয়ার হোসেনই একমাত্র নির্বাচিত উপাচার্য। কিন্তু অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে তিনি মেয়াদ উত্তীর্ণ সিনেট সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত ৩৩ ভোটের মধ্যে ১৩টি ছিল সিঙ্গেল ভোট। সিনেট সদস্যরা তিনজনের উপাচার্য প্যানেলে সর্বোচ্চ ‘তিনটি’ ভোট দিতে পারেন। ধারণা করা হয়, সরকার মনোনীত সিনেট সদস্যরা শুধু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে ‘সিঙ্গেল’ ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এটা তো প্রতিষ্ঠিত, তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেটে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে উপাচার্যের তিনজনের প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছেন। তার পরও প্যানেলে তিনি প্রথম হননি। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ৫৫ ভোট পেয়ে প্রথম এবং অধ্যাপক নুরুল আলম এবং তিনি ৩৩ ভোট পেয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় হয়েছিলেন।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন না। এ জন্য শিক্ষক সমিতি তাঁকে ত্যাজ্য করেছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক হওয়া না-হওয়া তাঁর সমস্যা বা অপরাধ নয়। আমরা মনে করি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে এটা তাঁর বাধাও নয়। সমস্যা হলো তাঁর আচরণ, মানসিকতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উদাসীনতা। আচরণের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কারও প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা নেই বলেই তিনি কোনো ছাত্রের খণ্ডকালীন চাকরি খেতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম উপাচার্য, তিনি তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্রের খণ্ডকালীন চাকরি খেয়ে ফেলেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কর্তৃক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। উপাচার্যের অনুগত কয়েকজন শিক্ষক আদালতে রিট করেছেন। আদালত কর্তৃপক্ষকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর কারণ দর্শাতে বলেছেন।
আমরা মনে করি, পুলিশ-আদালত দিয়ে প্রশাসন চালানো যায় না। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশাসন চালানোর মূল মন্ত্র, যা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেই। তাই, আর বিলম্ব না করে উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের জন্য সম্মানজনক হতে পারে। আর এ সত্যটি তিনি বুঝতে পারছেন না বলেই আমরা সরকার ও আচার্যকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।
ড. শামছুল আলম: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, কার্যনির্বাহী পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।