এক দমফাটা হাসিওয়ালার গল্প

মিজানুর রহমান খান (১৯৬৭–২০২১)
ছবি: খালেদ সরকার

সকালবেলা মিজান সাহেবের ফোন। আমি ‘মিজান সাহেব’, বলতাম। তিনি শুধরে দিতেন। স্যার, শুধু মিজান বললেই খুশি হব। সেই হাসি। সকাল সকালে ফোন করলাম, একটি মজার ঘটনা জানানোর জন্য। আপনি হয়তো জানেন না আপনার প্রোফাইলে সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল ভাইয়ের ছবি পেস্ট হয়ে আছে। আবার সে দমফাটা হাসি। আমি বোকার মতো বললাম, তাই নাকি! কই, আমি তো কিছুই দেখিনি। বললেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, তা আমি বুঝি, এটিই হয়ে আছে। তিনি বললেন, আমার ছেলে ঘুম থেকে উঠলে তাকে দিয়ে আমি ঠিক করিয়ে দেব। ও আপনাকে একটা ফোন দেবে।

আমি বললাম, তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে নামের মিলের কারণে নানা সময় আমার সঙ্গে নানা মজার মজার ঘটনা ঘটে। ওনার অনেক ভক্ত নানা সময় আমাকে ফোন করে বসেন। উনি মন্ত্রী হওয়ার পর আমাকে বিদেশ থেকে আমার কতিপয় বিদেশি বন্ধু অভিনন্দন জানিয়েছেন। সর্বশেষ যে গল্পটি বললাম, তা শুনে ওনার হাসি তো আর থামেই না। সেদিন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। সকালে তখনো ঘুম থেকে উঠিনি। শোয়া অবস্থাতেই একটা ফোন পেলাম। ওপাশ থেকে বলা হলো, চ্যানেল আই থেকে বন্যা আপা কথা বলবেন। আমি তো ঘুমাচ্ছি ভাই। কেন, কী কারণ? ওপার থেকে বলা হলো, ১০ মিনিট পর গানের অনুষ্ঠান থেকে আপনার সঙ্গে বন্যা আপা কথা বলবেন। ১০ মিনিট পর যথারীতি কথা হলো। আমি আবার শুয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পর আমার এক বন্ধু ফোন করল। বলল, তুমি কোথায়? বললাম চট্টগ্রাম। চ্যানেল আইতে তোমার কণ্ঠ শুনলাম, কিন্তু ছবিটা দেখলাম জননেতা তোফায়েল আহমেদের। ঘটনাটা কী? আমি তো তাই–ই ভাবছিলাম, হঠাৎ করে সকালবেলায় বন্যা আপা কেন আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আসল সাক্ষাৎকার ছিল তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে। কেউ ভুলে ফোনটা লাগিয়ে দিয়েছিল আমি তোফায়েল আহমেদকে। কদিন পর বন্যা আপা আবার ফোন দিলেন। একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করার অনুরোধ করলেন। বললাম আপা, আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে। আপনি যাঁকে চাচ্ছেন সেজন তো তিনি আমি নই। আমি গরিব মাস্টার তোফায়েল আহমেদ। আপনি আসলে চাচ্ছেন জননেতা তোফায়েল ভাইকে। কেউ ভুলে আমার নম্বরটি দিয়ে দিয়েছে। পরে দুজনেই হাসলাম। মিজান সাহেব শুনে সে কী হাসি! আর থামে না। বললেন, আমি তোফায়েল ভাইকে বিয়য়টা জানাচ্ছি। এ কথোপকথন হলো নভেম্বর (২০২০) মাসের কোনো একসময়।

ডিসেম্বরে অসুস্থ হলেন। খবরটা দেরিতে পেয়েছি। হঠাৎ করে মৃত্যুর সংবাদ। সারা দেশের সংবাদপত্রের পাঠক, সাংবাদিক আইন ও বিচারে আগ্রহী মানুষ বিষাদে ভারাক্রান্ত হলেন। মরহুম মিজানের স্ত্রী, পুত্র-কন্যার কথা কী বলব। একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনেই একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রিত ছিলাম। মিজান তাঁর ছোট ছেলে আননকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর থেকে একই গাড়িতে ঢাকা আসি। আননকে কতভাবে কত কিছু দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন তাতে বুঝেছিলাম, তিনি একজন ভীষণ সন্তানবৎসল পিতা এবং সন্তানের একজন অত্যন্ত ভালো বন্ধু। এখন তাঁরা কীভাবে সে অপূরণীয় শূন্যতার মধ্যে দিনাতিপাত করবেন?

তাঁর স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনদের কাছে তিনি একটি একক ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি, প্রথম আলো এবং দেশের সব বোদ্ধা পাঠকের কাছে একজন সত্যসন্ধানী সাংবাদিক, আইন ও সংবিধান বিশ্লেষক সর্বোপরি একজন সৎ, নির্লোভ ও নিষ্ঠাবান গবেষক-সাংবাদিক। আমি আর তাঁর মতো সে দমফাটা হাসিওয়ালার কোনো ফোন আর পাব না। অনেক উৎসুক ও চিন্তাশীল প্রশ্ন তাঁর কাছ থেকেই মাঝেমধ্যে পেতাম। সে রকম কোনো প্রশ্ন তাঁর মতো আর কেউ করবে না।

তাঁর স্মৃতি ও সৃজনশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রথম আলো ও প্রথমার কাছে নিবেদন থাকবে, তাঁর নির্বাচিত রচনাগুলোর একটি সংকলন প্রকাশের। প্রথম আলো একটি বৃহত্তর যৌথ পরিবার। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারা সব সময় মরহুম মিজানের পরিবারের সঙ্গে থাকবে। মরহুম মিজান বাংলাদেশের তরুণ সাংবাদিকদের কাছে একটি আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। সে আদর্শের আরও অনুসারী সাংবাদিক এ দেশে তৈরি হোক। ইহজগতের মতো পরলোকেও মরহুম মিজান সম্মানিত হোন।

ড. তোফায়েল আহমেদ লোকপ্রশাসন ও রাজনীতির অধ্যাপক এবং শাসনবিষয়ক লেখক ও গবেষক।

E-mail: [email protected]