এক মুক্ত বিবেক মানুষ

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশের বহুমাত্রিক প্রতিভার এক বিরল ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটল। এই অসাধারণ প্রতিভাদীপ্ত মানুষটি ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (০১.০৫.১৯৩০-১১.০১.২০১৪)। জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে। অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। মেধাবী ছাত্ররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতি-অনীহ হয়ে থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হাবিবুর রহমান মর্মচ্ছেদী দেশ বিভাগের অভিঘাতে উন্মূল অবস্থায় পার্শ্ববর্তী দেশে এসে সে দেশের উদ্ভট ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক পরিবেশেও তাঁর চিন্তাকে যে আধুনিক, মানবিক মূল্যবোধঋদ্ধ ও ইতিহাসের সুস্থ ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন, তাতেই বোঝা যায় যে তিনি স্থিরচিন্তা ও গভীর প্রত্যয়দীপ্ত নিজস্ব একটি অবস্থান প্রথম জীবনেই নির্ধারণ করে নিতে পেরেছিলেন। তবে প্রথমেই ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যে রক্ষণশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, সে অবস্থায় এতটা সচেতন যে তিনি হতে পেরেছিলেন, তার উৎস সম্পর্কে তিনি নিজে কিছু লিখে গিয়েছেন, এমন আমার চোখে পড়েনি। তবে সমাজবিজ্ঞানের অনুরাগ থেকে যতটুকু বুঝতে পারি, তাতে মনে হয়, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো একটি উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ এবং পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আলোকিত শিক্ষা পরিবেশে উদার চিন্তার প্রভাবশালী শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে শিক্ষালাভই তাঁকে বিচার-বিশ্লেষণপ্রবণ একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে তৈরি করেছিল। বিরুদ্ধ পরিবেশ এবং বিরূপ রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের উচ্চমানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকটা কাছাকাছি। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ববাংলার বাঙালিদের জাতিসত্তার প্রশ্ন এবং সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও এখানকার সংস্কৃতি একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন স্বকীয় চেতনায় প্রবহমান থাকুক, সেটাই ছিল শিক্ষকসমাজ, সংস্কৃতিভাবুক ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য পূর্ববাংলার সংস্কৃতিকর্মীদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে, জেল-জুলুম-নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। মূলধারার এই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক পরিবেশে নিজেকে যুক্ত করে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তখনকার তরুণ শিক্ষক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকেও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘ছাত্রজীবনে বন্ধুরা আমাকে বলত, রাজনীতি নাকি আমার জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এসএম হল ছাত্র সংসদের এক অতি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এ পথ আমার জন্য নয়।’ [বাংলাদেশ বৈদেশিক সংবাদদাতা সমিতির (ওকাপ) সঙ্গে বৈঠক, খবরের টানাপোড়েন, পৃষ্ঠা ৯৬] তাই পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মেধা, মনন ও প্রবণতাকে বুঝেই নিজেকে গভীরভাবে রাজনীতিতে না জড়িয়ে ধীরে ধীরে আইনগত পেশা, বুদ্ধিজীবিতা ও লেখকসত্তাকে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করেন। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে শিক্ষালাভ এবং নিলকনস ইন থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট ল হওয়ার মধ্যে তিনি তাঁর চিন্তাচেতনায় ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্তঃসারও গ্রহণ করেন। আমরা যে পর্যায়গুলোর মধ্য দিয়ে তাঁকে বেড়ে উঠতে দেখি, তার ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় অংশগুলোই তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিচারশীল, তীক্ষ পর্যবেক্ষণমূলক ও গভীরতাশ্রয়ী করে তুলেছিল। এভাবেই আমরা পেয়েছিলাম বিবেকবান, বিচক্ষণ এবং ইতিহাসের একটি কালের একজন অভিভাবকপ্রতিম অসামান্য এক মানুষকে।
দুই: বিচারপতি হাবিবুর রহমানের জীবন অভিনিবেশসহকারে দেখলে প্রথমে যে জিনিসটি লক্ষ করা যায়, তা হলো মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। এই বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকেই তিনি পূর্ববাংলার ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যেমন আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তেমনি প্রায় সারা জীবন ভাষাপ্রীতি এবং মাতৃভাষাসংক্রান্ত নানা উদ্ভাবনামূলক ও গবেষণাপ্রবণ চিন্তা-চেতনায় প্রাণিত ছিলেন। তাঁর লেখালেখির প্রায় অর্ধেকটা জুড়েই আছে মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয়। ১৯৭৪ সালে তিনি যথাশব্দ নামে যে থেসোরাস গ্রন্থটি রচনা করেন, ওই বিষয়ে অমন গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অতটা পরিপূর্ণভাবে আর ছিল না। কতটা অনুসন্ধিৎসা, নিমগ্ন শ্রম ও অসাধারণ ধৈর্য এর পেছনে ব্যয় করতে হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। বইটি প্রকাশের পর পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে এটি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়। বাংলা ভাষায় কিংবদন্তিপ্রতিম পণ্ডিত অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বইটি পড়ে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা বাংলা একাডেমি সম্প্রতি একখানি অতি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছে; সেটি হইতেছে ঢাকার ব্যারিস্টার শ্রীযুক্ত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কৃতি যথাশব্দ: এই বইখানি বাংলা ভাষার অতি বড় অভাব বহুলভাবে পূরণ করিল’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ঈদসংখ্যা, ২০০১)। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অদ্বিতীয় পুরুষ সত্যজিৎ রায়ও বইখানিকে নিত্যসঙ্গী করেছিলেন। সূচনাপর্বেই এমন বিরল মেধা ও অসামান্য শ্রমের পরিচয়বাহী একখানি গ্রন্থ রচনা হাবিবুর রহমানকে রাতারাতি বাঙালির বিদ্বৎসভায় একটি অনন্য আসন তৈরি করে দিয়েছিল।
এর পরে হাবিবুর রহমান যখন মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩) এবং বচন ও প্রবচন (১৯৮৫) রচনা করলেন, তখন বোঝা গেল যে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদাকে তিনি নানা মাত্রায় ও ক্ষেত্রে উপলব্ধি করার জন্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। কিছু পরে এ বিষয়ে তাঁর আরেক গ্রন্থ আমি কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬)। এর পরের বইয়ে বোঝা গেল, তিনি মাতৃভাষার প্রতি এই যে অঙ্গীকারদীপ্ত প্রত্যয়ে কাজ করছেন, তার উৎস একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা বলে (১৯৯৬) এবং টোয়েন্টি-ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি স্পিকস ফর অল ল্যাংগুয়েজেস (১৯৯৬)। বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খণ্ডবাক্য (১৯৯৭) বইটিকেও আমরা এ পর্যায়েই বিবেচনা করব। মাতৃভাষায় আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যাও যে সম্ভব, তা-ও এ বইটি রচনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে বোধ হয় তাঁর সর্বশেষ বই প্রথমে মাতৃভাষা, পরভাষা পরে (২০০৪)। আমার জানামতে, পৃথিবীর কোন দেশের কোন ভাষায় কোন কবি মাতৃভাষার সপক্ষে কোন কবিতা লিখেছেন, সে বিষয়ে কাজ করছিলেন বিদ্যাব্রতী মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। সম্ভবত সে বইটিও অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি হিসেবে তাঁর পড়ার ঘরে রয়ে গেছে। একজন চিন্তাশীল মানুষ মাতৃভাষাকে কতটা ভালোবাসলে সারা জীবন সে সম্পর্কে নানা চিন্তা-চেতনার অনুশীলন করতে পারেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বোধ হয় সমগ্র বিশ্বেই তার বিরল নজির।
তিন: বড় মাপের যেকোনো মাতৃভাষাপ্রেমী বাঙালি চিন্তকের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা-অনুরাগ ও রবীন্দ্রচর্চা পরস্পর সংলগ্ন। আসলে বাংলা, বাঙালিত্ব ও রবীন্দ্রনাথ একই সূত্রে গাঁথা। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু আমাদের মাতৃভাষাকে অনেকটা প্রাদেশিক, খুব বেশি হলে জাতীয় ভাষার পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন, তাই যেকোনো বাঙালি মাতৃভাষার সাধক রবীন্দ্রনাথে অনুরাগী হবেন না, এটা তো হতেই পারে না। তাই মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকেই হাবিবুর রহমান তাঁর চিন্তাজগতে রবীন্দ্রবীক্ষাকেও অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর প্রথম বইয়ের কথা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের এলাকা ছিল কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ও বহুমাত্রিক। এ বিষয়ে তাঁর বইগুলো হলো—রবীন্দ্র প্রবন্ধের সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার (১৯৮৩), রবীন্দ্র রচনার রবীন্দ্র ব্যাখ্যা (১৯৮৬), রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট, সংগীত ও সাহিত্য (১৯৮৬), কবি তুমি নহ গুরুদেব (১৯৯৯), রবীন্দ্র রচনার আইনি ভাবনা (২০০২), রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট (২০০৪)। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে হাবিবুর রহমানের এই বিচিত্র অনুসন্ধান আমাদের অভিভূত করে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে উপরিউক্ত বইসমূহে তিনি যে বিষয়গুলোকে বেছে নিয়েছেন, তাতে তাঁর রবীন্দ্র-চিন্তার স্বকীয়তা ও গভীরতর ভাবুকতার পরিচয় লক্ষ করা যায়। আসলে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর যে গভীর অনুরাগ, তাকে পূর্ণতা দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর রবীন্দ্রবিষয়ক রচনাসমূহ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। হাবিবুর রহমানের রবীন্দ্রবিচার আমাদের রবীন্দ্রচর্চাকে যেমন নতুন পরিসর দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে হার্দিক বিস্তার।
চার: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছাত্র ছিলেন ইতিহাসের। ইতিহাস-চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশকেই গভীর অনুসন্ধানের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রথমে মাতৃভাষা, পরে রবীন্দ্র অনুসন্ধান এবং শেষে বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা—এই নিয়েই বিশিষ্ট বাঙালি হাবিবুর রহমানের বাঙালিত্বের জগৎ। কোনোটিই কোনোটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং এই তিনেই তিনি সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালিত্বের পূর্ণতা উপলব্ধি করেছেন। এ বিষয়ের লেখালেখিতে এই তিনের সমন্বয় ও সংগতির বিস্তার আমরা লক্ষ করি। এর পটভূমি, প্রাসঙ্গিকতা ও সমগ্রতাকে উপলব্ধি করার জন্যই তিনি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস রচনায়ও মনোনিবেশ করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ (১৯৮৫)। বাঙালির ইতিহাসকে সহজ, স্বচ্ছন্দ ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এ বই শুধু উপাদেয়ই নয়, সব শিক্ষিত বাঙালির জন্য সব সময় হাতে রাখার উপযোগীও। বাংলাদেশের তারিখ (১৯৯৮) গ্রন্থটিও নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি গ্রন্থ বটে। ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক এবং সাধারণ পাঠক এ বই দুটি পড়ে সংক্ষেপে বাংলা ও বাঙালির একটি চমৎকার ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি হাতের কাছে পেয়ে যাবেন। তাঁর আরেকটি গবেষণামূলক ইতিহাসগ্রন্থ বং, বঙ্গ, বাঙ্গালা, বাংলাদেশ (১৯৯৯)। এ ছাড়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এর নানা সমস্যা, সংকট, সম্ভাবনা নিয়ে লেখা তাঁর কটি বইও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (১৯৯৭), জাগো ওঠো দাঁড়াও বাংলাদেশ (২০০০), চাওয়া পাওয়া ও না-পাওয়ার ইতিহাস (২০০১), বিষণ্ন বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩) ইত্যাদি।
পাঁচ: আমরা এই রচনায় ধর্মচর্চার বিষয়টিও যুক্ত করেছি। কারণ, ব্যক্তিজীবনে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রগাঢ় ধার্মিক। রোজা-নামাজ নিয়মিতভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁর অনুসন্ধান ছিল ভেতরসন্ধানী। ধর্মকে তিনি ব্যক্তিগত বিষয় এবং গভীরতর উপলব্ধির ব্যাপার বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনীতি বা তাঁর বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে ধর্মের কোনো অসংগতি বা বিরোধ তিনি লক্ষ করেননি। সে জন্যই তাঁর পক্ষে যেমন একই সঙ্গে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি হওয়া সম্ভব হয়েছিল, তেমনি ব্যক্তিজীবনে নিষ্ঠাবান ধার্মিক হওয়ার ক্ষেত্রেও কোনোই সমস্যা হয়নি। ধর্মচিন্তায়ও তিনি গভীরতাশ্রয়ী চিন্তক এবং ধর্মের মর্মমূল অনুসন্ধানে রত ছিলেন। এই নিরন্তর ধর্মসাধনার ফলেই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছিল কোরানসূত্র (১৯৮৪)-এর মতো একটি অসামান্য গ্রন্থ। এ বিষয়ে তাঁর আরেকটি বিরল কীর্তি কোরানশরীফ সরল বঙ্গানুবাদ (২০০০)। তিনি তোতাপাখির মতো না বুঝে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেননি। একে হাড়-মজ্জায় আত্মস্থ করেই এমন এক অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ দুটি বইয়ে তাঁর গভীরতর ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মোপলব্ধি বিধৃত হয়ে আছে।
ছয়: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে যে রেনেসাঁ-মানব বলা হয়, তা এ কারণেই যে তাঁর মানবিক অনুসন্ধান ছিল বিচিত্র, বহুমুখী ও বহুকেন্দ্রিক। মানুষ, মানবিক বিবেচনা ও ইতিহাসবোধের গভীরতা তাঁকে বহু বিষয়ে মৌলিক সত্য অনুধাবন করার এক অনন্য শক্তি দিয়েছিল। সে কারণেই তিনি একই সঙ্গে নিষ্ঠাবান বাঙালি, মুক্তচিন্তার সাধক, প্রগাঢ় ধার্মিক এবং সর্বোপরি এক বিচার-বিশ্লেষণপ্রবণ অসামান্য মানুষ। একজন বিচারপতি, আইনব্যাখ্যাতা, প্রশাসক এবং জাতির দুঃসময়ের কান্ডারি হিসেবে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি যে নির্ভীকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই নির্বাচনটি পরিচালনা করেছিলেন, তাতে মানুষটির শালপ্রাংশু দৈহিক অবয়বের মতোই ফুটে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের খরতা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে জাতিকে বিপদমুক্ত করার বিরল দক্ষতা। এই সময়ের অসাধারণ সাহসিকতা, দৃঢ়চিত্ততা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গমতার জন্যই মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান হয়ে ওঠেন জাতির এক অভিভাবকপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। এর পরে যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি নিষ্ঠাবান ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচক এবং জাতির পথনির্দেশক হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা দিয়ে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সুশাসনে স্থিত অবস্থায় উন্নীত করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন।
শামসুজ্জামান খান: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।