একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর। একসময় সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত ছিল। রোমের প্রাচীন অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে দেশের প্রথম মুক্তমঞ্চটি স্থাপিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল মাটির ক্যাম্পাসে। আজ ১২ জানুয়ারি। অর্ধশত বছর পূর্ণ করছে চিরসবুজ বিশ্ববিদ্যালয়টি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ভাষা আন্দোলনের স্মারক অমর একুশে ভাস্কর্যকে বুকে ধারণ করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়টির। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি ৪টি বিভাগ, ২৩ জন শিক্ষক ও ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ৩৪টি বিভাগ ও ৩টি ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ হাজার। শিক্ষক আছেন ৭০০ জন।
জাহাঙ্গীরনগর মানেই প্রতিবাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতের যৌথ মিছিল। হার না মেনে নেওয়া চোয়ালবদ্ধ লড়াই। কোনো অন্যায় ও অনিয়মের কাছে মাথানত করেননি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরপরই স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে এর শিক্ষার্থীরা মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ক্যাম্পাসে শহীদ টিটোর সমাধি ৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এ ছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, ক্যাম্পাসে শিবির নিষিদ্ধ করা, ছাত্রীদের হলে ফেরার সান্ধ্য আইন বাতিলের আন্দোলন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করেছিল।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে উজ্জ্বল অধ্যায় ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন। দেশে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মাইলফলক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরো দেশের জন্য উদাহরণ। নানা চাপ, প্রলোভন, হুমকি-ধমকিকে উপেক্ষা করে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে শাস্তির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন। জাবির শিক্ষার্থীদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যৌন নির্যাতন নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। কঠোর আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধর্ষকদের বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। ধর্ষকদের শেষ রক্ষা হয়নি।
কিন্তু এত অর্জন ধরে রাখতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর মনে হচ্ছে, ক্রমেই অধঃপতনের দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, সেশনজটে ধুঁকছে এখন। খোদ বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা। যে কারণে ওই নেতাদের পদ থেকে সরেও যেতে হয়েছে। উপাচার্য এক বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। এর আগে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেননি কেউ।
সবচেয়ে বড় অধঃপতন হচ্ছে আবাসিক চরিত্রটিই হারিয়ে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষকেরা অতিরিক্ত রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে যথাসময়ে কোর্স শেষ করতে পারেন না। ফলে সেশনজট বেড়েছে। এ কারণে নতুন সেশনের ক্লাসও যথাসময়ে শুরু হয় না। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে হলে পর্যাপ্ত সিট খালি না হলে ক্লাস শুরু করা সম্ভব না। একদিকে শিক্ষার্থীরা জটে আটকে আছেন, ওদিকে নতুনেরা কড়া নাড়ছেন। যে কারণে এখন অন্যান্য অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গণরুম সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। প্রথম বর্ষে গণরুম আর দ্বিতীয় বর্ষে এক বিছানায় দুজনকে তুলে হল কর্তৃপক্ষ। তাই বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থী এখন ক্যাম্পাসের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।
আজ থেকে ২০ বছর আগেও জাহাঙ্গীরনগরে এই দৃশ্য কল্পনাও করা যেত না। তখন প্রতিটি শিক্ষার্থী ক্লাস শুরুর আগেই হলে সিট পেয়ে যেতেন। শিক্ষার্থীদের হলে সিট দিতে না পারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা।

এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিভাগ বাড়ানোর আড়ালে আছে শিক্ষক নিয়োগের রাজনীতি। নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে নিজস্ব লোকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অফিস জনবল নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বাতাসে এখন নানা কথা ঘুরে বেড়ায়। কান পাতলেই শোনা যায়, অর্থের বিনিময়েও নাকি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসবের কোনো চাক্ষুষ বা দালিলিক প্রমাণ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে এখন এসব দুর্নীতির কথা প্রতিধ্বনিত হয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও ভাটা পড়েছে। আগে প্রতি সপ্তাহেই মুক্তমঞ্চে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হতো। এখন আর তেমন হয় না বলে শুনেছি। আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতাও অনিয়মিত। কর্তৃপক্ষ দায়সারাভাবে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আগের সেই সাংস্কৃতিক কর্মকালের জোয়ার আর নেই। বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, ক্যাম্পাস এখন পিকনিকের জন্য বাইরের বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতিকে ভাড়া দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের রুচির কতটা অধঃপতন হলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, তা চিন্তারও বাইরে।

বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা, জ্ঞান অর্জনের পাদপীঠ। এখানে বনভোজন হওয়ার কথা না। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। যেই উদ্দেশ্য নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল, তা এখন যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর আবাসিক না। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অপমৃত্যু হয়েছে। শিক্ষকেরা এখন নিজেরা নিজেরা সংঘাতে জড়ান। অকথ্য ভাষায় একে অপরকে গালাগাল দেন। গবেষক হওয়ার চেয়ে প্রক্টর, হাউস টিউটর হওয়া অনেক শিক্ষকের কাছে সব থেকে প্রার্থিত বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭০০ জন শিক্ষক আছেন। বছরে প্রত্যেক শিক্ষকের একটি করে হলেও আন্তর্জাতিক জার্নালে ৭০০ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু র‍্যাঙ্কিং দেখে মনে হয় না খুব বেশি প্রকাশিত হয়েছে। খুব বেশি শিক্ষকের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার অভিজ্ঞতাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু জ্ঞান উৎপাদনই করে না, জ্ঞানের আদান-প্রদানও করে। কেবল ৭০০ একরের মধ্যে আটকে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কোনো অবদান রাখা যাবে না, শুধু সনদ প্রদান ছাড়া। নিয়মিত প্রোগ্রামের ক্লাস পরীক্ষা না নিলেও সান্ধ্য ও সপ্তাহান্তের কোর্স নিয়মিতই শেষ করে দেন শিক্ষকেরা। এসব প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা জটে আটকে আছেন বলে কখনো শুনিনি। একই শিক্ষক নিয়মিত প্রোগ্রামের ক্লাস ও পরীক্ষা নিতে পারছেন না কিন্তু সান্ধ্য, সপ্তাহান্তের কোর্স ও বেসরকারি ক্লাসে কোর্স করাচ্ছেন নিয়মিত। জাহাঙ্গীরনগরের বেতন-ভাতায় না পোষালে এসব শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে ধ্বংস করে দেওয়া অত্যন্ত অন্যায়।

এসব ছাড়াও অপরিকল্পিত উন্নয়নের খপ্পরে পড়েছে জাহাঙ্গীরনগর। কেবল নতুন নতুন হল ও বিভাগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। একদিন দেখা যাবে, ইট-পাথরের এক বস্তিতে পরিণত হয়েছে গোটা ক্যাম্পাস। প্রতিষ্ঠার শুরুতে লক্ষ্য ছিল একটি পরিপূর্ণ গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। সেই পরিকল্পনার ধারেকাছেও নেই বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশে এখন উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনেক বেড়েছে। সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তাই পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাবিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। অযথাই অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করে গ্রন্থাগারটিকে আরও উন্নত করা দরকার। প্রতিটি বিভাগে গ্রন্থাগার ও কম্পিউটার স্থাপন করা দরকার। সংখ্যা কমিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য টার্ম পেপার, সেমিনার ও থিসিস বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ মানে কেবল নোট-শিট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে আসা না। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে।

সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পতন মানে রুচি ও মননের পতন। মূল্যবোধের অধঃপতন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবেই কর্তৃপক্ষের সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত বৈকল্যের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।


ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী