এমপির হুকুম ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’

সাংসদ আয়েনউদ্দিন

তিনি একজন আইনপ্রণেতা। দেশ ও জনগণের কল্যাণে আইনপ্রণয়নই তাঁর কাজ। কিন্তু তিনি ফরমান জারি করলেন, ‘মাইরের ওপর কোনো ওষুধ নাই।’

এই আইনপ্রণেতা হলেন রাজশাহী দুই আসনের সাংসদ মোহাম্মদ আয়েনউদ্দিন। গত ২৭ আগস্ট খেসারহাট পৌরসভায় জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ‘তথাকথিত সাংবাদিকদের’ শায়েস্তা করতে মার দেওয়ার চেয়ে বড় কোনো ওষুধ নেই। আয়েনউদ্দিন মোহনপুর উপজেলার সাংবাদিকদের সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন। তাঁর দাবি, এই সাংবদিকেরা সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার ছদ্মাবরণে এসব অপকর্ম করছেন। তিনি বলেছেন, আইন কঠোর। কিন্তু মারের ওপর কোনো আইন নেই। যখন যেখানে পাবেন এই সাংবাদিকদের ধরে আচ্ছা ধোলাই দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করার সাহস না পায়।

তাঁর এই বক্তৃতার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় তোলপাড় হয়। তিনি দাবি করেছেন, মোহনপুরে এত অনলাইন পত্রিকা আছে, যা সারা বাংলাদেশে নেই।

সাংসদের এই খবরটি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটির রাজশাহী প্রতিনিধি আয়েনউদ্দিনের নামে প্রচারিত বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভিডিওতে তাঁর বক্তব্য পুরোটা আসেনি, খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এরপর এই সাংসদ তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমি বলতে চেয়েছি জনগণের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। যাঁরা অনলাইন পত্রিকা খুলে নিজেদের সাংবাদিক দাবি করেন, আমি তাঁদের সম্পর্কে বলেছি। যেসব সাংবাদিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত, তাঁদের সম্মান রক্ষার জন্যই আমি এ কথা বলেছি।

মার বা মাইর দিয়ে সাংবাদিকদের সম্মান রক্ষা করা যায়, এই অদ্ভুত কথা এই প্রথম শুনলাম। যেমন একশ্রেণির পুলিশ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে মাদক নির্মূল করতে চায়। আইনপ্রণেতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেউ আইনের ধার ধারে না। একজন মাইর দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আরেকজন ক্রসফায়ার দিয়ে।

সাংসদ আয়েনউদ্দিন বলেছেন, ৬টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ও ৬৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত মোহনপুরের মতো একটি ছোট্ট উপজেলায় কমপক্ষে ৭৬ জন সাংবাদিক আছেন। এসব সাংবাদিক ও অনলাইন পত্রিকার কোনো অফিস নেই, কোনো গেটকিপার নেই। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করাও কঠিন। পুলিশ গ্রেপ্তার করলে কয়েক দিন পরই তাঁরা জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে লিপ্ত হন।

ওই সমাবেশে সাংসদ আয়েনউদ্দিন একটি সত্য কথা বলেছেন। কথাটি হলো ‘আমার দল আওয়ামী লীগেও চাঁদাবাজ আছে।’ আবার এই দলীয় চাঁদাবাজদের সঙ্গে নাকি ‘অপরাধী সাংবাদিকদের’ আঁতাত থাকে। এই সময়ে (করোনাকাল) দুই পক্ষ মিলে গঠিত সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে সাংবাদিক হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

এই সাংসদের কথা থেকে যে সত্য বেরিয়ে এসেছে, তা হলো কেউ অন্যায় করলে বা করেছেন মনে হলে থানা–পুলিশ কিংবা আদালতে গিয়ে প্রতিকার চাওয়ার প্রয়োজন নেই। সরাসরি তাঁর ওপর লাঠি চালাতে হবে। কেননা তাঁর দৃষ্টিতে লাঠিই হলো সবচেয়ে কার্যকর আইন। আয়েনউদ্দিন সাহেবের কথা মেনে নিলে দেশ থেকে থানা–পুলিশ সব তুলে নিতে হয়। আদালত বন্ধ রাখতে হয়। মারই একমাত্র বিচার হিসেবে ধরে নিতে হবে। আইনপ্রণেতা হিসেবে আমরা তাঁকে এই পরামর্শ দেব যে তিনি অপরাধীদের দমনে যে ওষুধ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন, সেটি সারা দেশেই চালু করতে পারেন। এ জন্য তাঁকে কষ্ট করে সংসদে একটি আইন পাস করতে হবে। তখন মোহনপুরের আইনপ্রণেতার মনোহারি আইনের সুবিধা সারা দেশের মানুষ পাবেন।

দশম সংসদে আমরা আবদুর রহমান বদি নামে এমন একজন সাংসদ পেয়েছিলাম, যিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে প্রকৌশলীকে পর্যন্ত মার দিয়েছেন। আয়েনউদ্দিন সাহেব এই মারকে আইনানুগ করতে সংসদে একটি আইন পাস করলে রাষ্ট্রের অনেক খরচ বেঁচে যাবে।

তিনি আরেকটি মূল্যবান কথা বলেছেন। জনগণের চেয়ে বড় শক্তি নেই। জনগণ যে শক্তি সেটি প্রমাণের একমাত্র উপায় হলো জনগণকে তাঁদের প্রতিনিধি বাছাই করার ক্ষমতা দেওয়া। আয়েনউদ্দিন সাহেব কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁর এলাকার ভোটাররা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছেন? তিনি সে কথা বলতে পারবেন না। সম্ভবত কোনো সাংসদই পারবেন না। ৩০ ডিসেম্বর কীভাবে ভোট হয়েছে, কতজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন, আর কত ভোটে কাকে জয়ী ঘোষণা করেছে কে এম নূরুল হুদা কমিশন, সেসব দেশবাসীর অজানা নয়। জনগণকে ওই দিনই ক্ষমতাহীন করা হয়েছিল। আর এখন সাংসদ মারের ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন।

আয়েনউদ্দিন বলেছেন, তাঁর দলেও চাঁদাবাজ আছেন। কিন্তু তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকার কতজন চাঁদাবাজ দলীয় কর্মীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটাও দেশবাসী তাঁর কাছে জানতে চায়। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কতিপয় আওয়ামী লীগার ও সাংবাদিকেরা মিলে চাঁদাবাজি করেন। কিন্তু তিনি মার দিতে বলেছেন শুধু সাংবাদিকদের। দলীয় কর্মীদের মার দেওয়ার কথা বললে তাঁরাও পাল্টা মার দিতে পারেন। এ কারণে এমপি মহোদয় মার দিতে বলেছেন সাংবাদিকদের। কেননা নিরীহ সাংবাদিকদের মার দিলে কেউ কিছু বলবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর এমনিতে সাংবাদিকেরা ভয়ের মধ্যে আছেন। তারপরও যদি দু–একজন এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলেন বা লেখেন, সেটি বরদাশত করা যায় না।
অতএব, মাইর দিয়ে ঠান্ডা রাখো।


সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।