কই আছে ঢাকার শতবর্ষী বৃক্ষরা

রাজধানী ঢাকার বয়স কত? ইতিহাসবিদদের মতে প্রায় ৪০০ বছর। কিন্তু এই শহরে ৪০০ বছরের পুরোনো কয়টি নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে? যদি ৩০০ বছরের কথা বলি, তা-ও মনে হয় খুব একটা কিছু পাওয়া যাবে না। স্থাপত্য নিদর্শনের কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা ৪০০ বছরের পুরোনো কোনো বৃক্ষ বা উদ্যানের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করি, তাহলেও হতাশ না হয়ে উপায় নেই। এমনকি রাজধানী ঢাকায় সঠিকভাবে ৩০০ বছরের পুরোনো কোনো গাছ বা উদ্যানেরও খোঁজ পাওয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, এই শহরের কোথায় কোনো গাছ বা উদ্যান ছিল, তার কোনো তথ্য-প্রমাণও কোথাও সংরক্ষিত নেই। এমন নেই-নেই অবস্থার ভেতর ঢাকার শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী গাছগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছি কয়েক বছর ধরে। মুশকিল হচ্ছে, এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বয়স নির্ধারণ করার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক গবেষণাগারও নেই। সর্বোপরি, এখানে তথ্যঘাটতির পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতারও বড়ই সংকট।
বছর কয়েক আগে ধানমন্ডির দুটি সড়কের উল্লেখযোগ্য কিছু গাছ নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য সিটি করপোরেশনের শরণাপন্ন হই। এই বিভাগ-সেই বিভাগ ঘুরে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে অনেকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো তথ্যই তিনি জানাতে পারেননি। কারণ, সিটি করপোরেশন সাধারণত ঢাকার বিভিন্ন পথপাশে রোপণ করা গাছের তথ্য সংরক্ষণ করে না। অবশেষ তারা একটি খোঁড়া যুক্তিও উপস্থাপন করে এই বলে যে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য কিছু বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং খোঁজখবর কিছু ওরাই জানাতে পারে। বৃথা চেষ্টা। যেখানে সিটি করপোরেশন নিজেই কিছু জানে না, সেখানে বেসরকারি সংস্থার তো কোনো দায় পড়েনি। অগত্যা স্থানীয় বয়স্কজনদের সাহায্য নিই। তাঁদের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে কিছুটা তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়। ঢাকার গাছ সম্পর্কে এটাই নগর কর্তৃপক্ষের বাস্তব চিত্র।
ঢাকার শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী গাছ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়েও একই ঝামেলায় পড়তে হয়। কোথাও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি ঢাকার গাছ নিয়ে এযাবৎ কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্যশুমারিও হয়নি। ফলে ঢাকায় এখন থেকে ৪০০ বছর আগে কোথায় কোন ধরনের গাছ ছিল, বা পরবর্তী শতাব্দীগুলোয় কী কী ছিল, সে সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে মাত্র ১০০ বছর আগের বিক্ষিপ্ত কিছু সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, যা বলধা গার্ডেন বা লন্ডনের কিউ উদ্যানের কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলকের রমনা নিসর্গ পত্তনের সমসাময়িক। কারণ, ‘রমনাগ্রিন’ ও বলধা গার্ডেন নির্মাণের কাজ শুরু হয় এক বছর আগে-পরে ১৯০৮ ও ১৯০৯ সালের দিকে। এখানে প্রাউডলকের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আবশ্যক। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে উদ্যাননগরের আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মকাণ্ডে রবার্ট লুইস প্রাউডলক ছিলেন বৃক্ষশোভিত সরণি ও উদ্যান নির্মাণের দায়িত্বে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের অন্যতম কর্মী। অখিল বাবু তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। পঞ্চাশের দশকের আগেকার রমনা ও সংলগ্ন এলাকার বৃক্ষসজ্জার সবটুকুই তখনকার সৃষ্টি। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় ঢাকায় রাজধানী নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং সম্ভবত প্রাউডলক পূর্ণাঙ্গ উদ্যান নির্মাণের অবকাশ পাননি। প্রাউডলকই মূলত এই জঞ্জালের নগরে আমাদের ফুসফুস সচল রাখার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পনার হাত ধরেই আমাদের বৃক্ষশোভা বর্ণিল হয়ে ওঠে। এ কারণে রমনার অধিকাংশ সুউচ্চ শতবর্ষী গাছগুলো প্রাউডলকের পরিকল্পনার অংশ বলে ধারণা করা হয়।
পুরান ঢাকায় এখন আর তেমন কোনো আদিবৃক্ষ বেঁচে না থাকলেও, বলধা গার্ডেনে কিছু শতবর্ষী গাছ এখনো বেঁচে আছে। আনুষ্ঠানিক উদ্যানের বাইরে পুরোনো ‘রমনাগ্রিন’ এলাকার কিছু গাছকেও ১০০ বছরের পুরোনো হিসেবেই শনাক্ত করা যায়। অবশ্য এসব গাছের বয়স ১০০ বছরের সামান্য কম বা বেশিও হতে পারে। এমনকি আমাদের অজান্তে ঢাকায় এমন বয়সী আরও কিছু গাছও থাকতে পারে।
সম্প্রতি ৪০০ বছর উদ্যাপন করেছে ঢাকা শহর। মানববসতি ও ইতিহাস-সংস্কৃতির দিক থেকে ৪০০ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। দীর্ঘ পরাধীনতা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা ও মাত্রাতিরিক্ত লালসার অপতৎপরতায় এখানকার অনেক ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাচীন বৃক্ষসম্পদও হারিয়ে গেছে। এ কারণে আমরা সন্ধান করেছি মাত্র শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী গাছগুলোর। এমন গাছের সংখ্যা মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। যদিও এসব গাছ রোপণের সঠিক কোনো সাল-তারিখ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তবু বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র, জনশ্রুতি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই এই গাছগুলোকে শতবর্ষী হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত গাছগুলো হচ্ছে রমনার মহুয়া, রমনার কুসুম, রমনার দেশি গাব, হেয়ার রোডের পাদাউক, বেইলি রোডের ব্ল্যাকবিন, ফুলার রোডের তেঁতুল, বাংলা একাডেমি, মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ আরও কয়েকটি স্থানের বট, চামেরি হাউসের ছাতিম, বাংলা একাডেমির বহেড়া, তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজের জংলিবাদাম ইত্যাদি। তবে এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন। আমাদের অজান্তে আরও কিছু শতবর্ষী গাছ থাকতেও পারে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ সবার প্রতি অনুরোধ, চিহ্নিত এই গাছগুলো যেন অতিসত্বর যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজটি সরকারি বা বেসরকারিভাবেও হতে পারে। কোনো একটি বেসরকারি সংস্থাও এ দায়িত্বটুকু পালন করতে পারে। আমরা শুধু চাই শত বছরের পুরোনো এই গাছগুলো যেন কালের সাক্ষী হয়ে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অংশী হয়ে আরও সহস্র বছর বেঁচে থাকে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
[email protected]