কথা রাখেননি সালাউদ্দিন

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনফাইল ছবি, প্রথম আলো

কাজী সালাউদ্দিন ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে লড়ার ঘোষণা দিলে ফুটবলপ্রেমীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। সালাউদ্দিন ফুটবলের যৌবন আবার ফিরিয়ে আনবেন। যেভাবে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতা–উত্তর দেশের ফুটবলকে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দর্শকেরা আবার টান টান উত্তেজনা নিয়ে জমজমাট লড়াই দেখতে বসে যাবেন।

সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম মহাতারকা। তার সেই ঝাঁকড়া চুলে ঢেউ খেলিয়ে ফুটবল নিয়ে ড্রিবল এখনো অনেকের স্মৃতিতে তাজা। কিন্তু কোথায় কী। সালাউদ্দিনের সেই জনপ্রিয়তায়ও এখন ভাটার টান। ফের সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বয়কট সালাউদ্দিন’ প্রচারণা চলছে। কিংবদন্তির সালাউদ্দিন এখনকার সালাউদ্দিনের কাছে অনেকটাই ম্লান ও ঝাপসা।

দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকার কিছু ইতিবাচক দিক আছে। সংগঠকেরা গোটা ফেডারেশনকে নিজস্ব পরিকল্পনামতো সাজিয়ে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। কেবলই পদ আঁকড়ে থাকা হয়। না আছে কোনো পরিকল্পনা, না আছে উন্নতির চিন্তাভাবনা। যে কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাধুলায় আমাদের তেমন সাফল্যও নেই। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অধিকাংশ সময় বাজেটের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করা হয়। বাজেটস্বল্পতা বড় সমস্যা। এর থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে পরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাব।

এর থেকেও বড় কর্মকর্তাদের স্বৈরাচারী আচরণ ও দুর্নীতি। বাজেট যা আসে, সেটাও বিভিন্নভাবে কর্মকর্তাদের পকেটে চলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর বিদেশভ্রমণের কথা এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এমনও হয়েছে, দলের সঙ্গে চিকিৎসক যাওয়ার বাজেট ছিল না। কিন্তু বাফুফের হর্তাকর্তারা ঠিকই গিয়েছেন। দেশে ক্রীড়া সংস্থা ও ফেডারেশন আছে ৫২টি। অধিকাংশেরই একই অবস্থা। বিভিন্ন লোকজন বছরের পর বছর পদ দখল করে আছেন। কিন্তু ফেডারেশনের কাজকর্মে কোনো গতি নেই; বরং অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও প্রতারণার অভিযোগও আছে।

সালাউদ্দিনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শুরুতেই কোটি টাকার সুপার কাপ আয়োজন করে সাড়া ফেলেছিলেন। ২০১১ সালে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার ফুটবল দলকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। আদতে এসব কার্যকলাপ দেশের ফুটবলে তেমন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি; বরং কোটি টাকার পুরস্কারের জন্য ক্লাবগুলোকে ঘুরিয়েছেন। প্রাইজ মানির জন্য ঘুরিয়েছেন বিদেশি দলগুলোকেও। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো পরের রাউন্ডে খেলে পুরুষ জাতীয় ফুটবল দল। ২০১০ সালে এসএ গেমসে (জাতীয় দল নয়) অলিম্পিক দল চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত হয়েছে। তিনি অন্তত ফুটবলকে মাঠে রেখেছেন। ঢাকার বাইরে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা চলমান রাখায় তাঁর কিছু অবদান রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে খেলা খুব একটা হয়নি।

ফুটবলার থেকে ক্রীড়া সংগঠক হওয়ার পর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে বাফুফে কর্মকর্তাদের দুদক ডেকেছিল। তাঁর সাংগঠনিক ব্যর্থতা অপরিসীম। ক্ষমতায় থাকার সাধ আরও অপরিসীম। ব্যর্থতা ও ব্যাপক সমালোচনাকে থোড়াই কেয়ার করে তিনি আবার সভাপতি পদের জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন। গুজব আছে, অপর সভাপতি প্রার্থী বাদল রায়কে চাপ দিয়ে বসিয়েও দিয়েছেন; যদিও বাদল রায় এমন কোনো অভিযোগ করেননি। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী তরফদার রুহুল আমিন চাপের মুখে মনোনয়নপত্রও নিতে পারেননি।

সালাউদ্দিন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতীকমাত্র। তাঁর মতো করেই অনেকে বিভিন্ন ফেডারেশনে পদ দখল করে আছেন দশকের পর দশক। এসব ফেডারেশনের সফলতা খুবই অনুল্লেখ্য। মাঠে নিয়মিত খেলা নেই। বরং নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতির কারণে খবরে আসে এসব ফেডারেশনের নাম। কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে তবিউর রহমান পালোয়ান আছেন তিন যুগেরও বেশি সময়। হ্যান্ডবলে আসাদুজ্জামান কোহিনুর ৩০ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। ভারোত্তলনে মাহিউদ্দিন ৪০ বছর যাবত সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতির পদে আছেন।এই হচ্ছে সালাউদ্দিনের সফলতার বয়ান।

কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লাও কম নয় একেবারে। বরং ব্যর্থতার ওজনই বেশি হবে। জাতীয় দল সাফ ফুটবলে তাঁর মেয়াদে একমাত্র ২০০৯ সালে সেমিফাইনালে খেলেছে। এরপর কখনোই গ্রুপ পর্বের বাধা পার হতে পারেনি। ২০১০ এসএ গেমস চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু পরের দুই গেমসে ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্ট। সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারেননি। ফুটবলের কোনো সূচি নেই। লিগ, টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় ক্লাবগুলোর সুবিধা বিবেচনা করে। ঢাকায় লিগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও সারা দেশে কোনো লিগ হয় বলে শোনা যায় না। একসময় চট্টগ্রাম লিগ ঢাকা লিগের সঙ্গে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পাল্লা দিত। চট্টগ্রাম আবাহনী, মোহামেডানের পাশাপাশি কাস্টমস, ইস্পাত একাদশ বা বাকলিয়া একাদশের নাম সারা দেশের মানুষই কমবেশি জানত। এখন ঢাকা লিগের ক্লাবগুলোর নামই অনেকে জানেন না।

সালাউদ্দিন নানা সময়ে নানা কথা বলে যথেষ্ট হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বড় বড় বুলি আওড়িয়েছেন। কখনো চেলসি, আয়াক্স আমস্টারডামের মতো একাডেমি গড়ার মুলা ঝুলিয়েছেন। প্রথম মেয়াদে একাডেমি নিয়ে অনেক কথা বলার পর অগ্রগতি কিছুই হয়নি। দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট বিকেএসপিতে কয়েক মাসের জন্য একাডেমি চালু করেও তা ছয় মাসের বেশি এগোয়নি। তিনি একবার বলেছিলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল দল বিশ্বকাপে খেলবে। এখন ২০২০ সাল। কী অবস্থায় আছে পুরুষ জাতীয় দল, এটা সবাই জানে। জাতীয় দলে ঘুরেফিরে একই মুখ। নতুন নতুন খেলোয়াড় উঠে আসছে না। মাঠপর্যায়ে নিয়মিত খেলার আয়োজন না থাকার কারণে অনেক তরুণ খেলোয়াড় ফুটবল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

সালাউদ্দিন ১৯৮৪ সালে ফুটবলার হিসেবে অবসর নেন। তিনি একমাত্র ক্রীড়াবিদ, খেলা থেকে বিদায়ের পর যাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধাসহ জাতীয় দলে বিভিন্ন মেয়াদে কোচিং করান। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধায় কোচিং করানোর পর ১০ বছরের বেশি সময় ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সুলতান-হেলালের কমিটিতে সহসভাপতি হন। ২০০৮ সালে বাফুফে নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী হন এবং মেজর (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরীকে হারিয়ে সভাপতি হন। মেজর আমিন সামরিক কর্মকর্তা হলেও ৮৫ ও ৯৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের সফল উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের রূপকার।

সাংগঠনিক দক্ষতা থাকলেও ফুটবলার সালাউদ্দিনের খ্যাতির কাছেই মূলত তিনি হেরে যান। সবাই পরিবর্তনের আশা করছিলেন। কিন্তু ফুটবলে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও নিজের ইমেজে পরিবর্তন এনেছেন সালাউদ্দিন। জনপ্রিয় খেলোয়াড় থেকে নিজেকে সমালোচিত ব্যর্থ সংগঠকে পরিণত করেছেন। নিজের অবস্থান তিনি নিজেই নষ্ট করছেন। আমার মতো অনেকের শৈশবের নায়ক সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের এই পরিণতি দেখে আমরা বেদনার্ত।

* ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক