করোনা রেখে যাচ্ছে সামাজিক গঞ্জনা

সামাজিক স্টিগমা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বাংলায় লেখালেখি অনেকটা কম। ইংরেজিতে এই ধারণাটিকে যেভাবে প্রকাশ করা হয়, বাংলায় এর যথার্থ সমার্থক শব্দই খুঁজে বের করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। এর অনেকটা কাছাকাছি বাংলা ভাবার্থ হলো কলঙ্ক, নিন্দা বা কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করা। তবে আমাদের দেশে যখন কলেরা কিংবা চিকেন পক্স হয়ে গ্রামের পর গ্রাম মৃত্যুর মিছিলে উজাড় হয়ে যেত, সেই সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে সাহিত্যে সংক্রামক ব্যাধির সামাজিক প্রভাবের বিষয়টি নানাভাবে এসেছে। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো লেখক তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেও আমরা এ বিষয়গুলোর উপস্থাপন দেখতে পাই। তবে এসব লেখায় সাধারণত মহামারিকালের মানুষের সামগ্রিক দুঃখ–দুর্দশার বিষয়গুলোই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। সে তুলনায় গবেষণাধর্মী লেখালেখি তুলনামূলকভাবে বেশ কম।

তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি হয়ে আসছে। তবে এখানে মজার বিষয় হলো তাদের গবেষণার প্রেক্ষাপট কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃতীয় বিশ্ব। সাম্প্রতিক করোনাকালে সংক্রামক রোগের কারণে রোগীকে হেয় করার প্রবণতাটি আবারও বিশ্বজুড়ে দেখা দেয়। এটি শুরু হয় চীনের উহানে করোনাভাইরাসের বিস্তারের পরপরই। প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা অনেক দেশে অবস্থানরত চীনা জনগোষ্ঠীকে করোনাকালে একটু ভিন্ন চোখে দেখার প্রবণতা শুরু হয়। এর সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোতে সামগ্রিকভাবে এশীয়দের সম্পর্কেও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে শুরু করে।

এমনকি আমাদের দেশেও করোনাকালের শুরুর দিকে মাস্ক পরা পূর্ব এশিয়ার চেহারার কোনো মানুষ দেখলেই বাঙালিদের মধ্যেও একধরনের ভীতি কাজ করত এবং জনপরিসরে তাদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ করা যেত। পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের সঙ্গে স্টিগমা নামক সামাজিক ব্যাধি নিজেদেরই আক্রান্ত করতে শুরু করে, যার ফলে অনেক মানুষকেই সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের কাজের মধ্যে আর্ভিন গফম্যানের ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘স্টিগমা: নোটস অন দ্য ম্যানেজমেন্ট অফ স্পয়েল্ড আইডেন্টিটি’ বইটি এ বিষয়ে অন্যতম একটি কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যেখানে তিনি সামাজিকভাবে কাউকে হেয় করার প্রবণতাকে একটি নির্দিষ্ট সমাজ ও সংস্কৃতির দ্বারা নির্মিত বলে যুক্তি দেন। এর ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন দুর্ভোগের পরে একধরনের পরিচিতির সংকটে পতিত হয়। চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানের আলোকেও দেখা যায়, সমাজ ও সংস্কৃতিই এ ধরনের সামাজিক স্টিগমা বা নিন্দা কিংবা কলঙ্কের বিষয়গুলোকে নানাভাবে পুনরুৎপাদন করে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক স্টিগমাকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার সময় এইচআইভি রোগে আক্রান্ত মানুষের অভিজ্ঞতাগুলোই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে।

সাম্প্রতিক একটি গুণগত গবেষণার মাধ্যমে আমরা দেখেছি যে করোনাভাইরাস–কেন্দ্রিক সামাজিক স্টিগমা কেবল সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান বা প্রকাশিত হয় না বরং আমাদের গবেষণার তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে অনেক মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যেও সামাজিক স্টিগমাকে কেন্দ্র করে একধরনের ভীতি বা সমাজে হেয় হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। ফলে অনেকের মধ্যেই করোনা সংক্রমণের খবরটি গোপন করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

আমাদের গবেষণার মাধ্যমে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে। সেটি হলো গ্রামাঞ্চলে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ তুলনামূলক কম বলে স্টিগমার বিষয়টি সেভাবে প্রকাশিত নয়, তবে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে গ্রামেও স্টিগমার উপস্থিতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শহরের ঘটনাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক প্রচার পেয়েছে মাত্র। পাশাপাশি শহর এলাকার অনেকের মধ্যেই ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর গোপন রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। এর সঙ্গে মানুষের সামাজিক মর্যাদাহানির বিষয়ও সরাসরি যুক্ত।

আমাদের গবেষণার তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে অনেক মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যেও সামাজিক স্টিগমাকে কেন্দ্র করে একধরনের ভীতি বা সমাজে হেয় হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। ফলে অনেকের মধ্যেই করোনা সংক্রমণের খবরটি গোপন করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

এ বিষয়ে অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি, এমনকি একটি পুরো পরিবারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এতে তাদের সামাজিক মর্যাদাহানির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও ঝুঁকি তৈরি করেছে।

স্টিগমা প্রসঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোরোগ নৃবিজ্ঞানী আর্থার ক্লেইনম্যান ‘অসুস্থতার বয়ান’ (ইলনেস ন্যারেটিভ) নামে একটি বইয়ে বলেন, সামাজিক স্টিগমার কারণে পরিবারের নিকটতম মানুষজন ছাড়া বাকিরা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে সরে যায় এবং তাকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। এর মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তি আরও বেশি মানসিক চাপে ভুগতে থাকে। বিষয়টি তার সুস্থতার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখজনকভাবে আমরা এর চেয়েও কষ্টকর উদাহরণ দেখতে পাই, যেখানে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি ভয়ের কারণে তাকে ‘একঘরে’ করে রাখা, এমনকি তাকে খাবার না দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

পাশাপাশি গবেষণায় আমরা দেখেছি যে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও আশপাশের মানুষ, এমনকি নিকটাত্মীয়স্বজনেরাও তার সঙ্গে আর আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে না। এ ধরনের নানা রকম স্টিগমার কারণে প্রতিদিনের মানসিক চাপ ব্যক্তির জন্য কষ্ট ও দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে। সমস্যা হলো এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশে সঠিক কাউন্সেলিং বা পরামর্শের সুযোগ একদমই কম।

এ ক্ষেত্রে আমরা স্টিগমার যে কটি ধরন পেয়েছি, তার মধ্যে অন্যতম হলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য, অবহেলা করা, আক্রান্ত ব্যক্তির (নারী) বিয়ে ভেঙে যাওয়া, কাজের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা বা চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়, আত্মীয়স্বজনদের দূরে সরে যাওয়া, পরিবারের মানুষের অবহলো ও খাবার না দেওয়া, সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে মৃতদেহ ফেলে চলে যাওয়া ও সৎকার না করা ইত্যাদি। সংক্রমণের ভয়ে সাধারণ চিকিৎসা না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। এসব বিভিন্ন রকম স্টিগমার মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানেরও অবনতি ঘটে, যা সমাজে তার আত্মপরিচয়কে সংকটাপন্ন করে তোলে, যা সমাজবিজ্ঞানী গফম্যানও তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন।

সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার বিষয়টি ঘটে থাকে প্রধানত অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং সংক্রামক রোগের প্রতি অযাচিত ভয় থেকে। এই ভয় তৈরি করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভ্রান্ত ধারণা ও তথ্য অনেক ভূমিকা পালন করে থাকে বলেও মতামত এসেছে। কেননা অনেকেই খুব সহজেই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতিসাবধানতার বশবর্তী হয়ে এমন কিছু করছেন, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এসব আদতে ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও পরিবারকে সমাজে নানাভাবে হেয় করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ জন্য করোনার মতো সংক্রামক রোগের কারণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যা আমাদের স্টিগমা তৈরির আচরণ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে। রোগীর সঙ্গে অসুস্থতার সময়ে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলার মানেই কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হেয় ও অবহেলা না করে বরং তার রোগমুক্তির জন্য মানসিক শক্তি অর্জনে সাহায্য কারা অধিক জরুরি।

বুলবুল সিদ্দিকী: সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক সেন্টার ফর পিস স্টাডিস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও

নূর নেওয়াজ খান: প্রভাষক, এনএসইউ ও পিএইচডি গবেষক, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।