করোনা সংকটকালেও কেন রেমিট্যান্স বাড়ছে

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি অব্যাহত আছেছবি প্রথম আলো

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স–প্রবাহ ক্রমেই কমতে থাকে। অনেকেই বলেছিলেন, করোনা মহামারির কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ক্রমান্বয়ে কমেছে, যা ভবিষ্যতে আরও কমতে থাকবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে করোনা চলাকালীন মে থেকে দেশের রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়তে থাকে, যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০১৯ সালের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের একই মাসগুলোতে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে প্রায় ৬৩, ৩৬ ও ৪৬ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণ কী? এবং এই উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠানো কত দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে?


প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতির মূলে অনেকগুলো কারণ বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, যাঁরা এত দিন বিদেশে সঞ্চয় করেছেন, তাঁরা করোনা মহামারিতে উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দায় চাকরি হারানোর কারণে সব সঞ্চিত অর্থ দেশে প্রেরণ করছেন।

দ্বিতীয়ত, যাঁরা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিলেন (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে), তাঁদের ব্যবসা করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা তাঁদের মূলধনের বাকি অংশ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

তৃতীয়ত, যাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে বা অন্যান্য উপায়ে অর্থের লেনদেন করতেন, তাঁরা করোনাকালে বাধ্য হয়ে (ইনফরমাল চ্যানেলগুলো নিষ্ক্রিয় থাকায় বা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায়) ফরমাল চ্যানেলে লেনদেন করছেন। ফলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে।

চতুর্থত, সরকারের রেমিট্যান্স প্রণোদনায় উৎসাহিত হয়ে যাঁরা এত দিন ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করতেন, তাঁরা এখন ফরমাল চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছেন। পঞ্চমত, এমনও হতে পারে যাঁরা কালো টাকা বিদেশে পাঠিয়েছেন, এই করোনা দুর্যোগের কারণে দেশে তাঁদের কিছু অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে এবং তাঁরা বিদেশ থেকে কিছু অর্থ বিভিন্ন মাধ্যমে ফেরত নিচ্ছেন। যদিও এ সম্ভাবনা অনেকটা কম।

বাংলাদেশে ফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহের নিমিত্তে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠানোতে উৎসাহ দিতে সরকার ২০১৯ সালের জুলাই থেকে রেমিট্যান্সের ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন যে রেমিট্যান্স প্রেরকদের ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রদানে সরকারের সেই কৌশল দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহের ঊর্ধ্বগতিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

এখন দেখা যাক বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া রেমিট্যান্স ডাটা কী বলছে? এই প্রণোদনা দেওয়া শুরু হওয়ার পরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৯) বাংলাদেশের রেমিট্যান্স–প্রবাহ এর আগের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন, ২০১৯) তুলনায় মোটেই বাড়েনি; বরং কিছুটা কমেছে। ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৯) আগের তিন মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স ৮ শতাংশ বেড়েছে। এটি বলে দিচ্ছে, প্রণোদনা সত্ত্বেও প্রবাসীরা খুব একটা বেশি অর্থ দেশে পাঠাননি। অর্থাৎ প্রণোদনার কিছু প্রভাব থাকতে পারে, তবে তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়।


এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে মৌসুমি কর্মসংস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে। তাই এ ধরনের শ্রমিকের ক্ষেত্রে বছরের কোনো কোনো মাসের আয় অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি থাকে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ওঠানামা থেকে তা স্পষ্ট। বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই বেশি রেমিট্যান্স আসে। আর মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকাংশই স্বল্প দক্ষ শ্রমিক। তাই রেমিট্যান্সের ডেটা বিশ্লেষণে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মাসের সঙ্গে মাসের তুলনায় এ ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর হয়। ত্রৈমাসিক বিশ্লেষণও মোটামুটি কার্যকর ফলাফল দিতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে রেমিট্যান্সের তুলনা করে থাকেন, যা থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছার সম্ভাবনা থাকে।

বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস সর্বশেষ রিপোর্টে বিদেশফেরত প্রবাসীদের সঞ্চয় দেশে নিয়ে আসাকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রবাহে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে করা হচ্ছে, ২০২১ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক কমে যাবে।

যা–ই হোক, এখন দেখা যাক বিশ্বব্যাংক এই রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কী বলছে? বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস সর্বশেষ রিপোর্টে বিদেশফেরত প্রবাসীদের সঞ্চয় দেশে নিয়ে আসাকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রবাহে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে করা হচ্ছে, ২০২১ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক কমে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে চাকরি না থাকলে যতই প্রণোদনা দেওয়া হোক, প্রবাসীরা অর্থ পাঠাবেন কোত্থেকে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের অনেকেই ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। যাঁরা এখনো চাকরিতে আছেন, তাঁদের অনেককে এই করোনাকালেই চাকরি হারাতে হবে। আর সেখানে যেহেতু নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই, তাই বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সত্যি হওয়ারই কথা।


তাই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, এই মহাদুর্যোগের সময়ে এই উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠানোকে স্বাভাবিক ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ফলে রেমিট্যান্সের এই ঊর্ধ্বগতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা নয়।


ড. নুসরাতে আজিজ : কানাডার আলগমা ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক।