করোনায় আক্রান্ত ট্রাম্প ও নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্ন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সবার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, এরপরে কী হবে? এবং নির্বাচনে এর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে? অথবা ট্রাম্প যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তবে কি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৃহস্পতিবার রাতে টুইট করে জানান যে, তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পের পরীক্ষার ফল পজিটিভ হয়েছে। তাঁর চিকিৎসক এই খবরের সত্যটা নিশ্চিত করেছেন। এর আগে প্রেসিডেন্টের একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হোপ হিক্স আক্রান্ত বলে জানানো হয়। গত কয়েক দিন ধরে ট্রাম্প যে সব নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তাতে হোপ তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ৩ নভেম্বর-এক মাসের চেয়েও কম সময় বাকি আছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যে অনেকেই হয় ডাকযোগে অথবা সশরীরে আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচনের এত কাছে এসে কোনো প্রার্থী অসুস্থ হননি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বয়স ৭৪ বছর, অনেকে মনে করেন তিনি তাঁর বয়সের তুলনায় স্থূলকায় এবং তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ে জনমনে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। কোভিভ-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে নানা বিবেচনায় যাদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ট্রাম্প সেই গ্রুপের মধ্যেই পড়েন। ফলে নানা ধরনের আশংকা তৈরি করছে। প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর স্ত্রী ইতিমধ্যেই সবার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। আগামী ১৫ দিন তাঁদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে; তবে তাঁর অবস্থার অবনতি না ঘটলে তিনি তাঁর কাজ অব্যাহত রাখতে পারবেন।

গত কিছুদিন যাবৎ ট্রাম্প সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নির্বাচনী প্রচারণার সময় সমাবেশ আয়োজন করেছেন এবং সেখানে বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি সব সময়ই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখিয়েছেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৭০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২ লাখ আট হাজারের বেশি। ট্রাম্প গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের সঙ্গে বিতর্কের সময় দাবি করেছিলেন যে, সামাজিক দুরত্ব না মেনে যেসব সমাবেশ হচ্ছে তাতে প্রায় কেউই মাস্ক পড়ছেন না এবং সেগুলো ভাইরাস ছড়াচ্ছে না। তিনি নিজে মাস্ক পরেছেন হাতে গোনা কয়েক বার এবং বিতর্কের সময়েও বাইডেনের মাস্ক পরা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। ট্রাম্পের দায়িত্বহীন আচরণ যে করোনাভাইরাস মোকাবিলাকে দুর্বল করেছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে এই বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি এর দায়িত্ব নিতে চাননি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আক্রান্ত হওয়ার পর যে প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে তা হচ্ছে তিনি যদি আরও অসুস্থ হন এবং দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হন তবে কী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫ তম সংশোধনী অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে যদি ট্রাম্প একেবারেই দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন এবং তাঁর নাম ব্যালট থেকে বাদ দিতে হয় তবে কী হবে। প্রথমেই বোঝা দরকার যে এতে করে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে না, বাতিলও হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিকেল ২-এ নির্বাচনের সময় এবং পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে। এর কোনো ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই। তাঁর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে সেটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। ১৮৪৫ সালে থেকে নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়েই হয়েছে। এমনকি ১৮৬৪ সালে দেশে গৃহযুদ্ধের সময়ও নির্বাচন হয়েছে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ২০ জানুয়ারি দুপুরে শেষ হয়ে যাবে।

ট্রাম্প যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তবে কী হবে? তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী বের করার পদ্ধতি দু’টি। রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কমিটি সভা ডেকে আরেক জন প্রার্থী ঠিক করতে পারে। এই কমিটির সদস্য ১৬৮ জন। অথবা জাতীয় কনভেনশন ডাকতে পারেন, তাঁর সদস্য ২৫৫০ জন। তাঁদেরকে ১০ থেকে ২০ দিন সময় দিতে হবে। সেই সময় নির্বাচনের আগে তাঁদের হাতে নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যালটে ট্রাম্পের নাম রেখে নির্বাচনের পরে ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যদের বলতে পারেন তাঁরা কাকে ভোট দেবেন। ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যরা মিলিত হন ১৪ ডিসেম্বর।
সবচেয়ে খারাপ চিত্রকল্প যা হতে পারে তা হচ্ছে, ট্রাম্প আর প্রার্থীই থাকছেন না। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতির কোনো উদাহরণ ইতিহাসে নেই। এর বাইরে সম্ভাব্য দু’টি চিত্রকল্প সহজেই ধরে নেওয়া যায়। প্রথম হচ্ছে আগামী পনেরো দিন পর ট্রাম্প সুস্থ হয়ে আবারও প্রচারণায় যুক্ত হতে পারেন। তখন তিনি তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠাকে তার পক্ষে কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি যুক্তি দিতে পারবেন যেমনটি আগে থেকেই বলছিলেন করোনাভাইরাস সাধারণ জ্বরের চেয়ে বেশি কিছু নয়, তিনি নিজে তা মোকাবিলা করেছেন। ফলে এত দিনের এই সব হচ্ছে কেবল ‘ধাপ্পাবাজি’-ডেমোক্র্যাটদের চাল। নিজেকে তিনি শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরারও সুযোগ পাবেন। এটি তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে। তিনি সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতির আশাও করতে পারেন। কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ে উদ্বেগ থাকবেই এবং ডেমোক্র্যাটরা এটা বলতে পারবেন যে, ট্রাম্পের অসুস্থতা প্রমাণ করছে তিনি যা বলেছিলেন সেগুলো যে মিথ্যাচার ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় চিত্রকল্প হচ্ছে, ট্রাম্প অসুস্থ হওয়ার কারণে এখন তাঁর অনুসারীরা, যারা মাস্কের এবং সামাজিক দূরত্বের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন যে, আসলে এটা ‘ধাপ্পাবাজি’ নয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত এতে আক্রান্ত হয়েছেন, তার অর্থ হচ্ছে এখন সাবধান হওয়া দরকার। তাঁরা এমনকি ট্রাম্পের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
এখনকার পরিস্থিতি থেকে ডেমোক্র্যাটরা কোনও সুবিধা নিতে পারবেন কিনা সেটাও অনেকের প্রশ্ন। ট্রাম্প বড় ধরনের সমাবেশ ছাড়া প্রচার চালাতে স্বস্তি বোধ করেন না, অন্তত আগামী ১৫ দিন তা তিনি পারবেন না। এটা অবশ্যই ডেমোক্র্যাটদের জন্য সুবিধার। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে এখন খুব কঠোর ভাষায় সমালোচনা করাকে ভোটাররা কীভাবে নেবেন সেটা তাঁদের বিবেচনা করতে হবে।

ইতিমধ্যে ট্রাম্প একটা বড় সুবিধা পাচ্ছেন। গত কয়েক দিন ধরে তাঁর কর ফাঁকি দেওয়া নিয়ে এবং প্রথম বিতর্কে অশোভন আচরণ করা নিয়ে যে সব আলোচনা চলছিল তা এখন পেছনে পড়ে গেছে। এই কারণে কেউ কেউ প্রকাশ্যে না হলেও ব্যক্তিগত আলোচনায় তাঁর অসুস্থতার খবর নিয়ে সন্দেহ করছেন, একে বলছেন ‘নির্বাচনী’ চাল। প্রেসিডেন্টের অতীত আচরণের কারণে এই ধরনের কথাবার্তা অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তবে এই অসুস্থতার কারণে আবারও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রশ্ন সামনে আসবে যা ডেমোক্র্যাটরা চাইছিলেন।
অভূতপূর্ব ঘটনার মুখে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা কেবল অনুমানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।