কল্পনা অপহরণের ১৭ বছর

অপহরণের পরদিন কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন। মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির প্রথম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ১৪ বছর তদন্তাধীন থাকার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে তা দাখিল করা হয়। বাদী ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দিলে পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেন। সিআইডি দুই বছর সময় নিয়ে অবশেষে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, বাঘাইছড়ি থানার পুলিশের প্রতিবেদন ও সিআইডির প্রতিবেদনের মধ্যে তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। কারণ, সব প্রতিবেদনেই আসামি শনাক্ত করা যায়নি উল্লেখ করে মামলাটিকে হালকাভাবে দেখার প্রবণতা প্রবল ছিল। অথচ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা তাঁর বোনের অপহরণের জন্য তৎকালীন সময়ের লে. কর্নেল ফেরদৌসসহ অন্য তিনজনের নাম উল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। কিন্তু তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে ফেরদৌসের জবানবন্দি দায়সারাভাবে গ্রহণ ও উপস্থাপন কমিশনের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করেছে। এ ছাড়া একটি বিশেষ গোষ্ঠী কল্পনা অপহরণ ঘটনার পরই এটিকে ‘হূদয়ঘটিত ঘটনা’ বলে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটিও ধোপে টেকেনি। পরবর্তী সময়ে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণাসংবলিত লিফলেট হেলিকপ্টারের সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, সংশ্লিষ্টতা যদি না-ই থাকে, তাহলে কল্পনা অপহরণের পর বিক্ষুব্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্ত করতে একের পর এক আজগুবি গল্প পেড়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ওই বিশেষ গোষ্ঠীটি কী স্বার্থ সিদ্ধি করতে চেয়েছিল!

বর্তমানে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে পুনঃ তদন্তাধীন। গত মে মাসে মামলার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার কথা থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা তা দিতে সমর্থ হননি। বরং তিনি এ মামলার তদন্তভার থেকে অব্যাহতি চেয়ে মামলাটি আবারও সিআইডির কাছে হস্তান্তরের জন্য আবেদন করেছেন বলে আদালত সূত্রে জানা যায়।

১৭ বছর ধরে মামলাটি যখন এহাত-ওহাত ঘুরতে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবে মামলার পরিণতি নিয়ে সংশয় তৈরি হবেই। আগের অন্তঃসারশূন্য তদন্তের পর যখন বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তার ওপর মামলাটির পুনঃ তদন্তের ভার দেওয়া হয়, তখন অনেকে আশা করেছেন শুধু একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবেই নয়, একজন নারী হিসেবেও তিনি বহুল আলোচিত কল্পনা অপহরণ মামলার ১৭ বছরের রহস্যের জট খুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু না হতেই ব্যস্ততার অজুহাতে তিনি এ মামলার তদন্তভার আবারও সিআইডির কাছে হস্তান্তরের আবেদনে বর্তমানে এ প্রশ্নই দেখা দিয়েছে। তাহলে কি কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি তিমিরে হারিয়ে যাবে!

কল্পনা অপহরণ ঘটনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নিপীড়নের চিত্র বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের নারীরা নিপীড়নের শিকার হলেও এ ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যেত। পাহাড়ের নারী অধিকারকর্মী ও সংগঠনগুলো মনে করে, অতীতে সংঘটিত ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় পাহাড়ে বারবার এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। কারণ, কল্পনা অপহরণের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আজ পার্বত্য চুক্তির পরে পাহাড়ে এভাবে নারী নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যেত না।

কল্পনা চাকমা সব সময় চেয়েছিলেন নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন একটি সমাজ, যেখানে নারীরা নিরাপদে থেকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবে। কল্পনার সেই চেতনাকে ধারণ করে পাহাড়ের নারীরা শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এখনো লড়াই করে যাচ্ছেন। কল্পনার প্রতিবাদী কণ্ঠ আজ হাজারো কণ্ঠের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের আনাচকানাচে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অশুভ শক্তির কালো থাবা রাতের আঁধারে কল্পনার অস্তিত্বকে পাহাড় থেকে চিরতরে মুছে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তাঁর প্রখর চেতনা আর প্রতিবাদের ভাষা আজও অমলিন আছে। যত দিন কাচালং-মাইনি-চেঙ্গী নদীর অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন কল্পনার চেতনাও বহমান থাকবে।

আমাদের বিশ্বাস, রাষ্ট্র কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাকে চিরতরে অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করতে চাইলেও পাহাড়ের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো কল্পনা অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি নিয়ে সদা জাগ্রত থাকবে।

ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।