কী ‘অভূতপূর্ব’ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে

ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন
ফাইল ছবি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সম্ভাব্য ফলাফলের হিসাব-নিকাশ হচ্ছে; যেকোনো নির্বাচনের আগেই এমন হয়। কিন্তু এ বছর হিসাব হচ্ছে, কী ধরনের ‘অভূতপূর্ব’ ও ‘অভাবনীয়’ ঘটনা ঘটতে পারে, যা সম্ভাব্য ফলাফলকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। নির্বাচনে পরাজিত হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকার এবং ডাকযোগে ভোট দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেষ্টার কারণেই এই সব প্রশ্ন উঠছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই এমন ব্যবস্থা আছে, যা গণতান্ত্রিক নয় এবং তা অতীতে রিপাবলিকানদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে; যেমন ২০১৬ সালের নির্বাচন। সেটা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও এক দলের প্রার্থীর ‘বিজয়ী’ হতে না পারা। প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নয়, ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি। এবার এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জরিপে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ২০১৬ সালের দুঃস্বপ্ন ডেমোক্র্যাটদের তাড়া করে ফিরছে।

২০০০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ বুশের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার কারণে আল গোরকে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে। ২০২০ সালে এই পরিস্থিতির আশঙ্কার কারণ রুথ বেইডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর তাঁর শূন্য আসন পূরণের জন্য ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির তাড়াহুড়া। অতীতের সব ইতিহাস এবং তাঁদের ২০১৬ সালের আচরণের বিপরীতে গিয়ে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেট ঝড়ের বেগে ট্রাম্পের মনোনীত এমি কোনি ব্যারেটকে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সোমবার সিনেটের জুডিশিয়ারি কমিটিতে শুনানি শুরু হয়েছে, ৩ নভেম্বরের আগেই ব্যারেট বিচারপতি হিসেবে শপথ নেবেন। নির্বাচন বিষয়ে কোনো আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্টে গেলে তার ফল সহজেই অনুমেয়।

আরও দুটো সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প আছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিথ্যা প্রচার চালিয়ে এসেছেন যে ডাকযোগে ভোটের কারণে ‘জালিয়াতি’ হবে। এ বছর সবচেয়ে বেশি ভোটার ডাকযোগে ভোট দেবেন; ১০ অক্টোবর পর্যন্ত একটি রাজ্যের হিসাব থেকেই এর মাত্রার ধারণা পাওয়া যায়। ডাকের ভোট গণনার জন্য সময় লাগবে; এই সময়ে রিপাবলিকান পার্টি ও ট্রাম্পের সমর্থকেরা এ নিয়ে বিতর্কের সূচনা করতে পারেন, গণনা বন্ধ করতে চাপ দিতে পারেন অথবা গণনা শেষে জো বাইডেন বিজয়ী হলে জালিয়াতির অভিযোগে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন।

এ নিয়ে আদালতে যখন পাল্টাপাল্টি মামলা চলছে এবং সুস্পষ্ট ফল হাতে নেই, সেই সময়ে ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যদের নির্ধারণ করবে কে? এই দায়িত্ব রাজ্যের আইনসভার ওপর। যে নয়টি রাজ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা, তার আটটির রাজ্য আইনসভার নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকান পার্টির হাতে। যদি একটি রাজ্যও মনে করে নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে, তবে আইনসভা তাদের পছন্দের রিপাবলিকান ইলেক্টর পাঠাতে পারে। অন্যদিকে ওই সব রাজ্যের ডেমোক্র্যাট গভর্নর ও সেক্রেটারি অব স্টেট তাঁদের পছন্দের ইলেক্টর পাঠাতে পারেন। এ নিয়ে আদালতে আরেক দফা লড়াইয়ের সূচনা হবে। ইলেকটোরাল কলেজের ভোট গণনার সময় পেছানোর সুযোগ নেই। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে ইলেকটোরাল ভোট গণনা করতেই হবে। এই সময়ে কোনো কোনো রাজ্যের পাঠানো ইলেক্টরের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কংগ্রেসে রিপাবলিকান পার্টির সদস্যরা বলতে পারেন, যাঁদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তাঁদের ভোট যেন বিবেচনায় না নেওয়া হয়। ধরা যাক, পেনসিলভানিয়ার ২০টি বা মিশিগানের ১৬টি ভোট গণনা করা হবে না। তার মানে এমন দাঁড়াবে যে কোনো প্রার্থীই প্রয়োজনীয় ২৭০টি ভোট পাননি।

সেই পরিস্থিতি সমাধানের পথ লেখা আছে সংবিধানে। বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে প্রতিনিধি পরিষদ। সে ক্ষেত্রে ভোট হবে একটি রাজ্যের জন্য একটি ভোট। এখন যে প্রতিনিধি পরিষদের অবস্থা, তা অব্যাহত থাকলে ২৩টি রাজ্যের প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্র্যাট আর ২৬টির রিপাবলিকান। একটিতে দুই দলের সদস্য সমান সমান। এই অবস্থা হলে ট্রাম্প পাবেন ২৬, বাইডেন ২৪ ভোট; ট্রাম্প আরেকবার প্রেসিডেন্ট হবেন, সাংবিধানিকভাবেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিক সমাবেশে এই হিসাবের কথা বলেছেন। নিউজউইক পত্রিকার টিম ওয়ার্থ এবং টম রজার্স ৩ জুলাই একটি প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, ফরিদ জাকারিয়া এ ধরনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন তাঁর অনুষ্ঠানেও।

প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নয়, ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি। এবার এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জরিপে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ২০১৬ সালের দুঃস্বপ্ন ডেমোক্র্যাটদের তাড়া করে ফিরছে

ইলেকটোরাল কলেজ নিয়ে আশঙ্কার আরেকটি দিক আছে। সেটা বোঝার জন্য ২০১৬ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে আরেকবার মনোযোগ দেওয়া দরকার। সেবার ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩০৪টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, হিলারি ক্লিনটন পেয়েছিলেন ২২৭টি। দুইয়ের যোগফল ৫৩১; তা হলে বাকি ৭টি ইলেকটোরাল ভোটের কী হলো? ওই নির্বাচনের সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় হচ্ছে এই সাতটি ভোট। নির্বাচনের রাতে দুই প্রার্থীর পাওয়া ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩০৬ ও ২৩২; কিন্তু ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ গণনার পর দেখা গেল, তা দাঁড়িয়েছে ৩০৪ ও ২২৭। অর্থাৎ ৭ জন (পাঁচজন ডেমোক্র্যাট ও দুজন রিপাবলিকান) ইলেকটোরাল কলেজ সদস্য তাঁদের রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের মতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভোট দেননি। কেউ কেউ ভিন্ন, ভাইস প্রেসিডেন্টকেও ভোট দিয়েছেন। তবে তাঁরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ভোট দেননি। আরও কয়েকজন চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সফল হননি। তাঁদের বলা হয় ‘ফেইথলেস ইলেক্টর’। ১৮০৮ সালের পর ২০১৬ সালেই একাধিক ইলেক্টর প্রতিশ্রুত প্রার্থীকে ভোট দেননি। যে পাঁচজন হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেননি, তাঁদের চারজন ছিলেন ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের; একজন কোনো ব্যক্তির নাম পর্যন্ত লেখেননি; লিখেছিলেন ‘ফেথ স্পটেড ইগল’। হিলারিকে ভোট দেননি, এমন আরেকজন ছিলেন হাওয়াইয়ের। ট্রাম্পকে ভোট দেননি টেক্সাসের দুজন।

২০১৬ সালে তো নয়ই, অতীতেও ফেইথলেস ইলেক্টররা নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করেননি। তাঁরা এটা জেনেই ভিন্নভাবে ভোট দেন যে তাঁদের ভোটে ফল বদলে যাবে না। ১৫টি রাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিতে আইন আছে, ইলেক্টরদের তাঁদের রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মতো করেই ভোট দিতে হবে। এই বছরের জুলাই মাসে এ বিষয়ে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, যেকোনো রাজ্য চাইলেই এ ধরনের আইন করতে পারে। অতীতে ফেইথলেস ইলেক্টররা ফলাফল নির্ধারণ না করলেও ভবিষ্যতে তা হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। সেটা অংশত নির্ধারিত হবে ইলেকটোরাল ভোটের ফল কতটা কাছাকাছি, তার ওপর।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর