কেমন হলো পাকিস্তানের নির্বাচন

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই অনেকে সন্দিহান। তদুপরি সন্ত্রাসের সূতিকাগার হিসেবেই পাকিস্তানকে দেখা হয়। হয়তো সে অপবাদ কিছুটা হলেও ঘুচবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে। দৃশ্যত সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার অঙ্গীকার। নওয়াজ শরিফের তৃতীয়বারের মতো উত্থান অনেকটা এ মতামতকে সমর্থন করে। পাকিস্তানের এই নির্বাচনে যদিও কোনো একক দল কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, তবে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) সমমনা ছোট কয়েকটি দলের সমর্থনে সরকার গঠন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত নেতা ছিলেন বিশ্বখ্যাত সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। অনেক বিশ্লেষকই ভেবেছিলেন ইমরান খানের দল নওয়াজ শরিফের দলের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে। অনেকেই ইমরানের প্রতি তরুণ ভোটারদের সমর্থনের কথা মাথায় রেখেই তেমন বলেছিলেন। কার্যত তেমনটি হয়নি। কেন্দ্রে ইমরান খানের দল তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ পর্যন্ত (১২ মে ২০১৩) ইমরান খানের দলের আসনসংখ্যা ৩১ এবং বিদায়ী শাসক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির আসনসংখ্যা ৩২। সে সঙ্গে রয়েছে করাচিভিত্তিক দল এমকিউএমের ১৬টি আসন। ইমরান খানের প্রধান বিরোধী দলের প্রধান হওয়াও হয়তো এবার হবে না। যদিও ইমরান করাচির কয়েকটি ও পাঞ্জাবের কয়েকটি আসনে কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছেন, কিন্তু ওই কয়টি আসন পেলেও তাঁর দল দ্বিতীয় বৃহত্তর বিরোধী দল হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও ইমরান খান বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারবেন বলে মনে হয় না। পিপিপি ও এমকিউএম বিরোধী জোট গঠন করলে ওই জোট থেকেই বিরোধীদলীয় নেতার আবির্ভাব হবে।

এ নির্বাচনের একটি বড় ঘটনা হলো ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের অভাবনীয় উত্থান। এই দল তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এর সাফল্য এবার কম নয়। কিন্তু তবে যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমনটি না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের দলের একচেটিয়া প্রভাব, আর ইমরানের দলের মধ্যবিত্ত ইমেজ। ইমরানের দল প্রান্তিক বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব জনগোষ্ঠীর ভোট আকৃষ্ট করতে পারেনি। তা ছাড়া সরকার চালানোর বা নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাও নেই ওই দলের। ইমরানের বৃহত্তর সমর্থকগোষ্ঠী শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাঁর দলের বড় সাফল্য খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে (সাবেক উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ)। একক বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সেখানেও বিরোধী দলের ভূমিকায় যেতে হতে পারে যদি নওয়াজ শরিফের দল এবং মওলানা ফজলুর রহমান ইমরানের দলকে ছাড় না দেয়। তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এ নির্বাচনের আরেকটি দুর্ঘটনা হলো পাকিস্তানের চলমান সংঘাত আর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের বিচরণক্ষেত্র খাইবার পাখতুনখাওয়ায় অত্যন্ত শক্তিশালী আঞ্চলিক দল এএনপির (আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি) অস্তিত্বই নেই। অথচ এমন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে তেহরিকের মতো নতুন দলের আগমন। এর প্রধান কারণ দৃশ্যত ইমরান খানের মার্কিনবিরোধী এবং বিশেষ করে, ওই প্রদেশের উপজাতিদের ওপরে মার্কিনদের ড্রোন হামলার বিরোধী ভূমিকা। ইমরান খান বরাবরই ড্রোন হামলা, তৎকালীন শাসক দল পিপিপির মার্কিন তোষামোদি ও ওই সরকারের দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। নওয়াজ শরিফের মতো ইমরানও পাকিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পক্ষপাতী। ইমরান খানের দল যদি ওই প্রদেশের সরকার গঠন করে, তবে ওই সরকারের পক্ষে তাদের কথা রাখা কতখানি সহজ হবে, তা হবে দেখার বিষয়। এমনটা করতে হলে কেন্দ্রে নওয়াজ শরিফের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। নওয়াজ শরিফ অতখানি যেতে রাজি হবেন কি না, তা-ও হবে দেখার বিষয়। অপর দিকে ওই প্রদেশে যদি পিএমএল-এন আর জেইউআই-এফের সরকার গঠিত হয়, তবে কেন্দ্রের নীতিনির্ধারণ সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে ইমরান খানের দলের ভূমিকা হবে লক্ষণীয় বিষয়। যদিও সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে ইমরানের দলের ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক, তবু নতুন দল হিসেবে তেহরিক-ই-ইনসাফ ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে।

পাকিস্তানের হালের নির্বাচনে দ্বিতীয় বড় ঘটনাটি হলো তিনবারের শাসক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কেন্দ্রে ও তিনটি প্রদেশে ব্যাপক ভরাডুবি। দলটি পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মাত্র একটিতে, সিন্ধু প্রদেশে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে এমকিউএমের সহযোগিতায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে পারে। তা ছাড়া অন্য তিনটি প্রদেশে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতোই পরিণতি হয়েছে। বিগত পিপিপি সরকারের বহু বড় নেতা, এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিলানির দুই ছেলেও এবারের নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছেন। পিপিপির এই বিরাট বিপর্যয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের পর সমগ্র পাকিস্তানে যে ধরনের সহমর্মিতা দেখা গিয়েছিল, তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ওই সময়কার নির্বাচনে। কিন্তু পাঁচ বছরের শাসনামলে ব্যাপক অব্যবস্থা, দুর্নীতি, দুজন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আদালত অবমাননার অভিযোগ, খোদ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদির কারণে নির্বাচনে এ ধস নেমেছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতীব দহরম-মহরমসহ উপজাতীয় এলাকায় প্রতিদিনের ড্রোন হামলা, পাকিস্তানি তালেবানদের ব্যাপক উত্থান, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পাকিস্তানের মাটিতে সরকারের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ওসামা বিন লাদেনের হত্যার অভিযান ইত্যাদির কারণে পাকিস্তানিরা পিপিপির বিরুদ্ধে এই অবস্থান নিয়েছে বলে মনে হয়। আগামী সেপ্টেম্বরে জারদারির প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও পিপিপির নেতৃত্ব নিয়ে সন্দিহান। নির্বাচনের আগে বিলাওয়ালের দেশত্যাগও পিপিপির জন্য বড় রকমের ধাক্কা ছিল। সব মিলিয়ে পিপিপির ভবিষ্যৎ সুখকর হবে না, বিশেষ করে তেহরিক-ই-ইনসাফের অভ্যুদয়ের পর।

পাঞ্জাবে একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকছে নওয়াজ শরিফের দল। অপর দিকে ২৭২টি আসনে সরাসরি নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের দল পেয়েছে ১৩৭টি আসন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট ৩৪২ আসনের ৭০টি আসন আনুপাতিক হারে বণ্টন হয়। যার মধ্যে ৬০টি নারী ও ১০টি সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত। সেখান থেকে যে আসনগুলো পিএমএল-এন পাবে, তাতেও এককভাবে সরকার গঠন সম্ভব হবে না। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন হবে ন্যূনতম পক্ষে ১৭২টি আসন। ইতিমধ্যে নওয়াজ শরিফ বলেছেন, তিনি নির্দলীয়দের সহযোগিতা নেবেন না। সমমনা অন্য দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করবেন। এই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যদিও ইতিপূর্বের দুই দফার কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি, তবু পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনিই হবেন প্রথম রাজনীতিবিদ, যিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রায় সব দল এবং বিশ্বের বহু দেশের নেতারা। তাঁদের মধ্যে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও। নওয়াজ শরিফের বিজয়ে ভারতের আনন্দিত হওয়ার কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে তাতে সন্দেহ থাকলেও নির্বাচনে জয়ে নওয়াজ শরিফকে মোবারকবাদ জানিয়েছেন ওবামা। নওয়াজ শরিফের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হয়, তা দেখার বিষয়। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে তাঁর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতির যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক নীতি নয়, নওয়াজ শরিফের সামনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ অনেক চ্যালেঞ্জ। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নওয়াজ শরিফ কতখানি সার্থক হন, তা দেখতে সমগ্র বিশ্ব উদ্গ্রীব থাকবে। তবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে ক্ষমতার সে পালাবদল হতে যাচ্ছে, তাতে পাকিস্তানিরা অবশ্যই  আনন্দ ও গর্ব বোধ করতে পারেন। আশা করি, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর গণতন্ত্রের সুফলের সর্বপ্রথম স্তর। পাকিস্তানের নির্বাচন তারই প্রমাণ।

l এম সাখাওয়াত হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার।