ক্লিনিকে পুলিশের মৃত্যু

মানসিক সমস্যায় ভুগে হাসপাতালে ভর্তির পর এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর ও মৃত্যুর ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ব্যথিত ও বিচলিত। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য নিবেদিত একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে সংঘবদ্ধভাবে মারধর ও পরিণতিতে তাঁর মৃত্যুর ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা অবশ্যই আশা করব, অনতিবিলম্বে আইনানুযায়ী দোষী ব্যক্তিদের বিচারসহ সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ও সংস্থার জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। যাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তঁাদের দ্রুত বিচার ছাড়াও এবারের ঘটনার বিবিধ মাত্রা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রকে এটা ঠিক করতে হবে যে তারা শুধু এএসপি আনিসুল করিম হত্যার বিচার এবং বেআইনিভাবে পরিচালিত মাইন্ড এইড হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করার মধ্যেই তার দায়দায়িত্ব পালনকে সীমিত রাখবে কি রাখবে না।

অপ্রিয় বাস্তবতা হলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভিকটিম হলে যে ধরনের প্রতিকার মেলে, আমজনতা ভিকটিম হলে তেমনটা দেখা যায় না। বাংলাদেশকে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মো. সাহেদের রিজেন্ট, সাবরিনা-আরিফের জে কে জি এবং মাইন্ড এইডের উপাখ্যানে প্রকৃত অর্থে কোনো ভিন্নতা নেই। এসবই দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যাহত প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অক্ষমতার প্রতিফলন।

কারণ, আমরা অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছি যে দেশের স্বাস্থ্যসেবা থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আলাদা করে, অর্থাৎ যথাগুরুত্ব দিয়ে কখনো ভাবা হয়নি। অযত্ন-অবহেলার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্বতন্ত্র সাইকোলজি বিভাগ (বেশির ভাগ স্থানে নামকাওয়াস্তে) খোলা হয়েছে। এসব জায়গায় মানসম্মত সেবা মেলে কি না, সেটা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

গত ৫০ বছরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নতির জন্য শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম সরকারের আমলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা কাজ করেন। কিন্তু দেশের বেসরকারি খাতের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সদের গুণমান বিচারের দায়িত্ব বা নজরদারি করার অধিকারও দেওয়া হয়নি। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাত শুধু বিশেষায়িত খাতই নয়, এর রয়েছে বাড়তি সংবেদনশীলতা। শুধু চিকিৎসক বা নার্স নন, এই খাতের প্রতিটি স্তরের (হাসপাতালের আয়া ও ঝাড়ুদার পর্যন্ত) কর্মীদেরই দরকার উত্তম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতি চলছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাইকিয়াট্রিক বিভাগের চেয়ারম্যান ঝুনু শামসুন্নাহার মঙ্গলবার আমাদের বলেছেন, দেশে মনোরোগ চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীর উল্লেখযোগ্য সংকট আছে। সরকারি সমীক্ষা বলছে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় বয়স্কদের ১৬ ভাগ ও শিশু-কিশোরদের ১৮ ভাগ ভুগছে। অথচ এ বিষয়ে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা অনধিক ৩০০। অন্যদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ইনস্টিটিউটে এক দশক অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সমীক্ষার ওই ফলের চেয়ে বাস্তবে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। নারীর সংখ্যাও উদ্বেগজনক। সুতরাং সার্বিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নে নতুন করে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।

এটা অনুমেয় যে মাইন্ড এইডের মতো ছাড়পত্র বা অননুমোদিত ক্লিনিকের সংখ্যা কম নয়। আবার যঁারা অনুমোদিত, তঁারা যে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ‘বৈধতা’ ম্যানেজ করেননি, তা-ও বলা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও তার মন্ত্রণালয়ের উচিত এই খাতের কার্যক্রম বিষয়ে দেশবাসীর সামনে একটি পরিচ্ছন্ন চিত্র তুলে ধরা দরকার। আনিসুল করিমের ওপর নিষ্ঠুরতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সেখানে দক্ষ লোকবলের অভাব ছিল। আমরা আশা করব, আনিসুল করিমের ওপর নিষ্ঠুরতার ঘটনার সূত্র ধরে সংস্কারের একটি বাস্তবসম্মত কর্মসূচি এই রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। এই ঘটনা যেন কেবলই পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার মৃত্যুর বিচারের আলোকে না দেখা হয়।