খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়: উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ পথপ্রথম আলো ফাইল ফটো

সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে । অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত উপাচার্য এই নোটিশ দিয়েছেন। নোটিশে বলা হয়েছে, ‘স্বাভাবিক একাডেমিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, প্রশাসন ভবনে তালাবদ্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকে রাখা ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিল বেআইনি, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।’ গত ১ ও ২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে। ওই আন্দোলনের সঙ্গে চারজন শিক্ষকের ‘সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে’ মর্মে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়েছে। একটি ঘটনার কোনোরূপ তদন্ত ছাড়াই সংশ্লিষ্টতা ‘প্রতীয়মান হয়েছে’ বলার মধ্যেই অসৎ উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

উপাচার্যের মেয়াদ আছে আর তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। নয়তো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে তিনি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতেন না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপাচার্য মতপ্রকাশের পথ অনেকটাই অবরুদ্ধ করেছেন, যা সংবিধানেরও লঙ্ঘন। সেখানে মুক্তচিন্তার কোনো অবকাশ নেই। তারপরও এবার শিক্ষার্থীরা সুচিকিৎসা, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, বেতন-ফি কমানো, সহশিক্ষা কার্যক্রম অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতির প্রতিকার, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী অধ্যাদেশের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। গত বছরের নভেম্বর মাসে তাঁরা পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে লিখিত দিয়েছিলেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় এ বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের দাবি আগেই মেনে নিলে জানুয়ারিতে এসে তাঁদের মাঠে আন্দোলন করতে হতো না।

আমাদের দেশের অসৎ উপাচার্যরা মেয়াদ পূরণের আগে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি করে যান। সে জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার থাকেন, তাঁদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করা হয়। যাতে শেষ পর্বের দুর্নীতি নিয়ে কোনো কথা না হয়। বর্তমান উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানকে নিয়ে এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগও সর্বজনবিদিত। তাঁর দুর্নীতির তদন্ত করছে দুদক।

করোনার সময়ে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমও বন্ধ। উপাচার্যের মেয়াদ আছে আর তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। নয়তো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে তিনি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতেন না। যাওয়ার আগে প্রায় দেড় শ জনবল নিয়োগের কাজও তিনি সম্পন্ন করছেন। যে উপাচার্য নানা অপরাধের অভিযোগে নিমজ্জিত, তিনি যে অভিযোগে শিক্ষকদের নোটিশ দিয়েছেন, তা নেহাতই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সামনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলেন। বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের সামনেই উপাচার্য তাঁকে হাফ প্যান্ট পরা প্রসঙ্গসহ অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। সেই চাকরিপ্রার্থী পরবর্তী সময়ে নিজের ফেসবুকে এই অভিযোগ তোলেন। অভিযোগকারী এটাকে ‘মানসিক ধর্ষণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। গণমাধ্যমে ওই বোর্ডের একজন সদস্য বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রজিকুল ইসলাম উপাচার্যের আপত্তিকর প্রশ্ন করার বিষয়ে নিজেদের বিব্রত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। অপর একজন শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুজিত সরকারও উপাচার্যের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেওয়ার কথা বলেছেন। এ কথা বলার পরপরই বিশেষজ্ঞ প্যানেল থেকে অধ্যাপক সুজিত সরকারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ যে সত্য, তা প্রত্যক্ষকারীর বয়ানে পরিষ্কার।

উপাচার্যের এমন কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। শিক্ষকেরা আলাদা ব্যানারে মানববন্ধন করে নারী প্রার্থীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ সম্পর্কে উপাচার্যের কাছে জানতে চান। একজন উপাচার্য যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উচিত ছিল তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা, অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া।

উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক দুর্নীতি নিয়ে লিখিত অভিযোগ এনেছেন। তাঁরা সেখানে কোন কোন ভবনে কী কী রকমের দুর্নীতি হয়েছে, সেসব উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ভয়াবহ দুর্নীতি হলো জীবনানন্দ দাশ ভবনে ৫ ইঞ্চি পুরু ছাদ হওয়ার কথা থাকলেও করা হয়েছে প্রায় ৩ ইঞ্চি। এরই মধ্যে ভবনে অনেক ফাটল দেখা দিয়েছে। ভবনটিকে অনিরাপদ ঘোষণা না করে সেখানে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। ওই ভবনে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করেন।

উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে অনেক উপাচার্য লাগামহীন হয়ে পড়েন। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে সীমাহীন লজ্জাকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। সরকারের উচিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কাজের টেন্ডারে অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। সেখানে অনিয়মের মাধ্যমে চরম আলোচিত দুর্নীতিবাজ জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সূত্রপাত হলে সেই দরপত্র বাতিলপূর্বক নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। শিক্ষকেরা লিখিত অভিযোগ করেছেন, অজ্ঞাত কারণে আবারও জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, জি কে শামীম বর্তমানে সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে কারাগারে আছেন।

উপাচার্যের স্বজনপ্রীতি নিয়ে মানবকণ্ঠ একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে। সেখানে দেখা যায় উপাচার্যের আত্মীয়তার ধরন ও নাম উল্লেখ করে মোট ১৪ জন আত্মীয়ের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে একজন চুরির দায়ে ধরাও পড়েছেন। উপাচার্যের ১৪ জন আত্মীয় সবাই মেধার জোরে যে নিয়োগ পাননি, এটি সহজেই অনুমেয়।

দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের লোক নিয়মিত খবর রাখেন। তাঁদের মাধ্যমে সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত খবর সবার আগেই পাওয়ার কথা। যদি কোনো কারণে না-ও পেয়ে থাকে, তাহলে অন্তত গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তো তারা জানে। তারপরও উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে অনেক উপাচার্য লাগামহীন হয়ে পড়েন। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে সীমাহীন লজ্জাকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চেয়েও ভয়াবহ খবর আছে। সরকারের উচিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো উচিত, যিনি যৌন নিপীড়নসহ অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত তাঁর, নাকি যুক্তিসংগত ন্যায্য দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে? অনতিবিলম্বে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রত্যাহার করা জরুরি। উপাচার্যকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। এটা না হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রক্ষা করা কঠিন হবে, আর উপাচার্যরাও অধরা থেকে যাবেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও রক্ষা করা যাবে না।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক।

[email protected]