গণতন্ত্র ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ অসম্ভব

অলঙ্করণমাসুক হেলাল

দুর্নীতি একটি আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধানসূত্র জবাবদিহি ও গণতন্ত্রের মধ্যে। কারণ, দুর্নীতি ও জবাবদিহির মধ্যে একটা সুস্পষ্ট আন্তসম্পর্ক বিদ্যমান। প্রিন্সিপাল-এজেন্ট-ক্লায়েন্ট তত্ত্বে এজেন্ট ও ক্লায়েন্টের মধ্যে বোঝাপড়া ও যোগসাজশের ফলেই দুর্নীতির সূত্রপাত যখন প্রিন্সিপাল তথা জনগণের কাছে এজেন্টকে (রাজনীতিক ও আমলা) কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। এখানে ক্লায়েন্ট হচ্ছে তারা যারা সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স, পারমিট, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি পেতে চায় বা সরকারি অফিসে বিভিন্ন কাজের জন্য যাদের যেতে হয়।

জবাবদিহি ও সুশাসন তথা গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কারণ, একটা শুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশেই রাজনীতিক বা আমলার সঙ্গে সরকারি অফিসে কাজের জন্য যাওয়া মানুষদের এই যোগসাজশ ঠেকানো সম্ভব। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সুযোগ নিয়ে আমলারা দুর্নীতির ফাঁদ পাতেন এবং মানুষ নিরুপায় হয়েই ঘুষ দেয়, ঘুষ দিতে হয়।

অমর্ত্য সেন তাঁর দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা বইয়েও গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। তিনি গণতন্ত্রকে একটি শাশ্বত মূল্যবোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থাকবে বহু দল ও নির্বাচন, বিরোধী দলের সমালোচনা এর অপরিহার্য অংশ এবং এমন একটি ব্যবস্থাই পারে দুর্ভিক্ষ রোধ করতে। তাঁর ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম বইয়েও তিনি একই অভিমত প্রকাশ করেন এবং উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের উপস্থিতি যে জরুরি—এ কথা তিনি জোর দিয়ে বলেন।

দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে আর গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। গণতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন তথা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ করা যায় না—এটা ওই গবেষণাগুলোর মূল বক্তব্য। লিপসেট, মেলটজার ও রিচার্ড, ড্রেজ ও সেন, বোয়াক্স, লেইক ও বম, ব্রাউন ও মোবারক, বেন আলী ও সাহা, সাহা ও ঝাং—এ রকম অসংখ্য গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়। কউফম্যান ও ক্রায়াই তাঁদের গবেষণা থেকে আমাদের পরিষ্কার জানান, সুশাসন একটা দেশের মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে। আর আগেই বলা হয়েছে, গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন হয় না। নর্থ, বুটকিউইকজ ও ইয়ানিকয়া, ডেজেও, নওয়াজ—তাঁদের সবার গবেষণার ফলই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। সম্প্রতি জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এমআইটির প্রভাবশালী অধ্যাপক ডারোন এসিমগ্লু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ১৭৫টি দেশের ওপর যে গবেষণা পরিচালনা করেছেন, তাতে মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারের ওপর গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পান। শুধু তা-ই নয়, এই প্রভাব উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরনির্বিশেষে সত্য এবং পুঁজিতে, বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগের সঙ্গে যা বাড়তে থাকে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই একসময় সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট ব্যবস্থা চালু ছিল। কিউবা আর উত্তর কোরিয়া ছাড়া আর কোনো দেশে এই ব্যবস্থা আর বহাল নেই। রাশিয়াসহ সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত সব প্রজাতন্ত্রই এখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী। চীনে একদলীয় শাসন ছাড়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর কোনো উপাদান অবশিষ্ট নেই, তা এই ব্যবস্থাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।

সর্বহারার একনায়কত্ব একটি চমৎকার দর্শন, সন্দেহ নেই। বিপত্তি শুরু হলো যখন পার্টির নেতা-কর্মীরা আর সর্বহারা হতে অপারতা প্রকাশ করলেন অর্থাৎ পার্টির সদস্যরা যখন সম্পদ ও উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হতে চাইলেন। দেশে যখন গণতন্ত্র বা বহুদলীয় ব্যবস্থা নেই, পার্টি ভেতরেও যখন গণতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত, নেতারা যখন আমলাদের মতো আচরণ করেন এবং শত অভিযোগ সত্ত্বেও নেতা পরিবর্তনের কোনো প্রক্রিয়া নেই, তখন দুর্নীতির আগমন ঘটতে বাধ্য। কারণ, দুর্নীতিই পারে পার্টির নেতাদের সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিক হতে সাহায্য করতে। বস্তুত পরবর্তী বংশধরেরাও যাতে পুরুষানুক্রমে তাঁদের আহরিত সম্পদ ভোগ করে যেতে পারেন, এই রকম একটা নিষ্কণ্টক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টি নেতারাই সোভিয়েতের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন।

জ্যঁ পল সার্ত্রের কমিউনিজমে বিশ্বাস সর্বজনবিদিত। যদিও তিনি কখনোই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। তিনি আমৃত্যু কমিউনিজমে আস্থাশীল ছিলেন, তবে তিনি স্তালিনের নীতির সমালোচক ছিলেন এবং কমিউনিজমকে একটা মানবিক রূপ দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি যে কিউবাকে এতটা সমর্থন করতেন তার কারণ কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল। কিউবায় পার্টি কংগ্রেসের আগে সারা দেশে খোলা মাঠে ও দেয়ালের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ ১৯৯১ সালের কংগ্রেসে এ রকম ৮৯ হাজার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরের ও বাইরের সব মিলিয়ে ৩৫ লাখ কিউবান অংশ নিয়েছিলেন। এখানে পার্টির বাইরে থেকে যে কেউ পার্টির বা পার্টির কোনো নেতার বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ তুলতে পারেন। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজনকে তাঁর নির্বাচনী আসন থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। কিউবা সম্পর্কে যে কথাগুলো বলা হয়, তার কেন্দ্রীয় বার্তা হলো গণতন্ত্র। অর্থাৎ গণতন্ত্র ও বিরোধী পক্ষ ছাড়া ভারসাম্যহীন অবস্থায় দুর্নীতি দেখা দিতে বাধ্য।

বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর আত্মজীবনীর মুখবন্ধে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। একটা হলো: বিপন্ন মানবতার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। সম্ভত সে কারণেই তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রতিনিধি হয়ে ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সমাজতন্ত্রের প্রতি মোহভঙ্গ না হলেও সোভিয়েত ব্যবস্থা তাঁর ভালো লাগেনি। বাক্‌স্বাধীনতা, বিরোধী দলের অস্তিত্ব ও তাঁদের সমাবেশ করার স্বাধীনতা ছাড়া এই যে ব্যবস্থা, এ থেকে জন্ম নেয় স্বৈরাচার, যা বার্ট্রান্ড রাসেল নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এক মাসের ভ্রমণ শেষে তিনি যা লিখলেন, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘একনায়কতন্ত্রের সব কলাকৌশল দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। বিরোধী দলের এমনকি অন্য বাম দলগুলোরও কথা বলার ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত।’ পাঠক যদি বিস্মৃত না হন, তাহলে মনে থাকার কথা যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার শাসন আমলে বাম দলগুলোকেও সমাবেশ করতে দেয়নি। পুলিশের বেধড়ক পিটুনির দৃশ্য সবারই মনে থাকার কথা।

বাথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জো ডেভাইন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গল্পকে প্রকৃত উন্নয়ন বলতে নারাজ। বাংলাদেশ যখন ইতিমধ্যেই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে, তখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ডেভিড লুই তাঁর বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি গ্রন্থে বাংলাদেশের সুশাসনের চরম অভাব ও সীমাহীন দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, পার্লামেন্টারি সিস্টেমের সুফল বাংলাদেশে অনুপস্থিত। প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও দুর্নীতির সূচকে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার মানে হলো, যেটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা হচ্ছে, এটা আসলে গণতন্ত্র নয় অর্থাৎ ডেভিড লুইয়ের বক্তব্যই যথার্থ। কারণ, গণতন্ত্রের মূল কথা হলো জবাবদিহি। একজন সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জবাবদিহির পরিবর্তে টাকা বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন, কারণ টাকা হলেই তিনি পার্টির মনোনয়ন পাবেন এবং ভোট কিনতে পারবেন। দুর্নীতি করলে যেহেতু শাস্তি হয় না, তাঁর জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তিনি মনে করেন। ভোটারবিহীন নির্বাচন হোক বা সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক—দুই ক্ষেত্রেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন, এমন মনস্তত্ত্বে সাংসদেরা তাড়িত।

* ড. এন এন তরুণ: রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর