গণতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ

মিসরের গণতন্ত্র
মিসরের গণতন্ত্র

মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষা করার লক্ষ্যে গঠিত সরকারি কমিশনের পক্ষ থেকে এজ্জেদিন চুকরি ফিশেরি মিসরীয় সংবিধানের নতুন খসড়ার ব্যাপারে ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখেছেন। ৫০ সদস্যের কমিশন খসড়া সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করেছে, যা নিয়ে জানুয়ারিতে গণভোট হবে। গণভোটে সমর্থন পেলে এই নতুন সংবিধান ২০১২ সালের সংবিধানের স্থলাভিষিক্ত হবে, যেটি এ বছরের ৩ জুলাই মিসরের সর্বোচ্চ সেনা কমান্ডার আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির এক নির্দেশে স্থগিত হয়ে যায়। সিসি একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকেও অপসারণ করে আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা বলেন।
লাখ লাখ মিসরীয় নাগরিক মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করে আগামী ২৫ জানুয়ারির মিসরীয় গণজাগরণের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের সংগ্রামে ফিরে গেলে মিসরীয় সামরিক বাহিনীর গণতন্ত্র রক্ষার লক্ষ্যে ঘোষিত একটি রূপরেখার অংশ হিসেবে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফেসবুকে এজ্জেদিন ফিশেরি ওই পোস্টে যা লিখেছেন, তার কিছু বিষয়ের সঙ্গে দেশি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গবেষকদের অনেকেই একমত প্রকাশ করেছেন। বিষয়গুলো সংক্ষেপে এ রকম, ১. মানুষের এ পর্যন্ত জানা সব সংবিধানের থেকে এটি উত্তম নয়। এতে কিছু অনুচ্ছেদ আছে যেগুলোর সঙ্গে আমি একমত নই। আবার অনেক কিছু এ সংবিধানে নেই। কিন্তু নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়-অপরাধকারীদের শাস্তিদানের নীতিগুলো আগের যেকোনো সংবিধানের তুলনায় এ সংবিধানে অনেক ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; ২. উদারপন্থী, ইসলামপন্থী বা এমনকি নিরাপত্তামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক—কারও আকাঙ্ক্ষাই শতভাগ পূরণ করবে না এই সংবিধান। উল্টা বরং উল্লিখিত সব শ্রেণীর মানুষকেই রাগান্বিত করবে এমন কিছু উপাদান এই সংবিধানে আছে। সেই উপাদানগুলোর কারণেই তারা পরস্পরের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার কোনো বিকল্প দেখতে পাবে না; ৩. যেসব লোকের সঙ্গে আপনার চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের মিল নেই, তাদের সঙ্গে একই ভূমিতে যদি আপনাকে সারা জীবন বসবাস করতে হয়, আর কোনো বিকল্প ভূমি যদি আপনাদের না থাকে, তাহলে আপনাকে তাদের সঙ্গে আপস-সমঝোতা করতে হবে।
রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক সাদ আল-দিন ইব্রাহিম মন্তব্য করেছেন, পৃথিবীতে এমন কোনো সংবিধান নেই, যার সব বক্তব্যের সঙ্গে দেশের সব মানুষ একমত পোষণ করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের ঐকমত্যের ভিত্তিই তো গণতন্ত্র। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫২ সালের বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ১৯২৩ সালের সংবিধানই ছিল সর্বোত্তম। তিনি ২০১৪ সালের নতুন সংবিধানটি ১৯২৩ সালের সংবিধানের খুবই কাছাকাছি। এটি একটি বড় ব্যাপার, কারণ এটি প্রণয়নের কাজে সমাজের বৃহৎ অংশই শামিল হয়েছিল। ইব্রাহিম উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে নতুন সংবিধান একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাওয়া পুরস্কার, যে বিপ্লব মিসরীয়দের ভয় দূর করেছে, দূর করে দিয়েছে মোবারক আমলের রাজনীতিবিমুখতা, তাদের মধ্যে জাগিয়েছে বিপুল রাজনৈতিক সচেতনতা।
সম্প্রতি এমন উদ্বেগের কথা জানা যাচ্ছে যে নতুন সংবিধানের মধ্য দিয়ে মিসরে আরও সামরিক কর্তৃত্বের ভিত্তি গড়ে উঠবে। কিছু মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন কথাবার্তা প্রচার করছেন। তাঁরা খসড়া সংবিধানে বর্ণিত সামরিক বাহিনীর ভূমিকা-সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোর অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। যেমন, একটি অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, সামরিক আদালতে বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচার করা যাবে; যদিও অনুচ্ছেদটিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে, কোনো সামরিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানো ছাড়া আর কোনো অপরাধের অভিযোগে কোনো বেসামরিক ব্যক্তিকে সামরিক আদালতে বিচার করা যাবে না। এ রকম বিধান পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে।
আরেকটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী তাদের বাজেট গোপন রাখতে পারবে। এবং তৃতীয় এক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট যাঁকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দেবেন, তাঁর ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সুপ্রিম কাউন্সিলের সম্মতি থাকতে হবে।
একটি ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতিতে এই অনুচ্ছেদগুলো যুক্ত করা হয়েছিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি জনগণের পক্ষে সেনাবাহিনীর সমর্থন ব্যক্ত করে মুরসি সরকারকে উৎখাত করার পর তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকেও পদচ্যুত করা হবে না—এটা নিশ্চিত করতে সংবিধানের খসড়ায় এ বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছিল। সালাফি নুর পার্টির সঙ্গে কিছু সমঝোতার প্রতিফলনও এ খসড়ায় রয়েছে। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী আল-আজহারসহ অন্যান্য স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সালাফি নুর পার্টি অংশ নিয়েছিল। সালাফি নুর পার্টি গণভোটে এই সংবিধানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, মিসরে চলমান পরিস্থিতির আলোকে এই সংবিধানের মাধ্যমে সর্বাধিক অর্জন সম্ভব।
এটা নিশ্চিত যে নুর পার্টির অংশগ্রহণ এবং আল-আজহার ও অন্যান্য স্বতন্ত্র ইসলামি ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধিত্বের কারণে মিসর আরও বিভক্তি, সহিংসতা ও নৈরাজ্য থেকে রক্ষা পেয়েছে। এই সংবিধান মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার সমর্থকদের অভিসন্ধিগুলোও রোধ করতে পেরেছে। তারা দেখাতে চাইছে, মিসরে যা চলেছে তা রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলার, উদারপন্থী ও খ্রিষ্টানদের লড়াই। ইসলামের বিরুদ্ধে বাকি সবার যুদ্ধ। অথচ বাস্তবে এটা মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে এক ক্ষুদ্র চরমপন্থী গোষ্ঠীর লড়াই, যে গোষ্ঠীটি রাজনৈতিক মতলব হাসিলের লক্ষ্যে ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করে।
ইসলামি আইন ও তা কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, সংবিধানে এ-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মিসরের চার্চের প্রতিনিধিরা গত বছর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি থেকে বেরিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার পোপ দ্বিতীয় তাওয়াদ্রোস সংবিধানের নতুন খসড়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মিসরীয়দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই খসড়া সংবিধানকে ভারসাম্যপূর্ণ বলে বর্ণনা করে বলেছেন যে মিসরের ইতিহাসে ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রক্রিয়ায় মিসরের চার্চের প্রতিনিধিদের সর্বাত্মক অবদান রাখা উচিত। আগের সংবিধানের জন্য মিসরের খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী যে আঘাত পেয়েছিল, এখন তার থেকে হাজার গুণ বেশি আনন্দিত নতুন সংবিধানের খসড়াটি পেয়ে। বিশেষত, এই কারণে যে নতুন খসড়ার প্রস্তাবনায় এই ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে যে মিসরীয় ভূমি সব ধর্ম-বর্ণের মিসরীয়দের অভিন্ন ভূমি, মিসরীয়রা এক অভিন্ন জাতি। খ্রিষ্টান বিলিয়নিয়ার নাগিব সাভিরিস বলেছেন, ২০১৪ সালের নতুন সংবিধান সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো, এটির খসড়া রচনায় অতিরক্ষণশীল দল নুর পার্টিরও সম্মতির ভিত্তিতে। তিনি জোর দিয়েছেন, গণভোটে তিনি অবশ্যই এ সংবিধানের পক্ষে ভোট দেবেন। তিনি আরও বলেছেন, গণভোটের ফলাফলের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে যাবে যে মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এক বিপুল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে, কোনো ‘ক্যু’র ফলে নয়।
সংবিধানের খসড়া রচনা শেষ করে তা অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুড বিপুলসংখ্যক জাল খসড়া সংবিধান ছাপিয়ে প্রচার করা শুরু করেছে যে এই সংবিধানে মিসরকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, নাস্তিকদের ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী পুলিশের সহযোগিতায় কতগুলো বিশেষ টিম গঠন করেছে, যারা সংবিধান নিয়ে গণভোটের ব্যাপারে সব ধরনের হুমকি ও নৈরাজ্য প্রতিহত করবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।