গণতন্ত্রের রামদা, শটগান ও লাঠি সংস্করণ

সংঘর্ষের সময় রাম–দা নিয়ে ধাওয়া দিচ্ছেন পাকুন্দিয়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি নাজমুল হক। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকুন্দিয়া থানার পাশে।ছবি: তাফসিলুল আজিজ

সোমবার প্রথম আলোয় রামদা ও শটগানধারীদের দুটি ছবি ছাপা হয়েছে। একটি প্রথম পাতায়। আরেকটি দ্বিতীয় পাতায়। ছবি দুটি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা সদরের। দলীয় কোন্দলের জের ধরে সেখানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। একটি ছবিতে দেখা যায়, সদলবলে উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি নাজমুল হক দেওয়ান রামদা হাতে প্রতিপক্ষের লোকজনকে ধাওয়া করছেন। আর শটগান নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন জেলা শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা আতাউল্লাহ সিদ্দিক ওরফে টাওয়ার মাসুদ।

আশির দশকের মাঝামাঝির একসময় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর মতিউর রহমানের মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর কারণে। ৫ একর জমির ওপর তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’। পরে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে তিনি মারা যান এবং তাঁর মুসলিম মিল্লাত বাহিনী বিলুপ্ত হয়ে যায়। আজ মিল্লাত বাহিনী নেই, কিন্তু শটগান ও রামদাধারী নতুন বাহিনী আছে।

কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় তা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁদের আস্থা কম। বরং তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে রামদা ও শটগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনেক বেশি উৎসাহী। তাঁরা মনে করেন, যাঁর গায়ের জোর আছে, তিনিই থাকবেন সবকিছুতে, দলে কর্তৃত্ব করবেন। যাঁর জোর কম, তাঁকে সরে যেতে হবে।

দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় শর্টগান নিয়ে মহড়া দেন জেলা শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা আতাউল্লাহ সিদ্দিক মাসুদ। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকুন্দিয়া থানার পাশে।
ছবি: তাফসিলুল আজিজ

সাংসদ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম ভাইস চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ বনাম যুবলীগ, যুবলীগ বনাম ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে খুনোখুনি, মারামারি, হানাহানিও কম হয়নি। শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগকে যতই সুশৃঙ্খল, সুসংহত সংগঠন বলে দাবি করুন না কেন, ৭১ বছর বয়সী এই দলটির ভেতরে-ভেতরে কাজ করছে অনেক ঘুণপোকা।

করোনাকালে রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ আছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ত্রাণকাজে অংশ নেওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর পাকুন্দিয়াসহ অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ‘আত্মত্রাণে’ ব্যস্ত। ত্রাণ কমিটি থেকে কেউবা পদত্যাগও করেছেন। কেউ প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার মহড়া দিয়ে চলেছেন। সুশৃঙ্খল দলের নমুনা বটে!

এর আগে আগস্ট মাসে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের মারামারি হয়। যে টেঁটা মাছ ধরার জন্য তৈরি, আওয়ামী লীগের নেতারা সেটাই ব্যবহার করছেন একে অপরকে ঘায়েল করতে। একই মাসে আওয়ামী লীগের ফরিদপুরের নগরকান্দায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত ও ছয়জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফরিদপুর আওয়ামী লীগে দুই ভাইয়ের কাহিনি হলিউডের ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমাকেও হার মানায়।

ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের এসব মারামারি সামাল দিতে থানা-পুলিশকে ভীষণ বেগ পেতে হয়। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘর্ষ হলে পুলিশ বিরোধী দলের কর্মীদের পিটিয়ে ঘরে তুলে দেয় কিংবা ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। এতে মন্ত্রী-সাংসদেরা তাদের ওপর খুশি হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হলে পুলিশ থাকে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। কোনো পক্ষকে বাধা দিলে কিংবা নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও তাঁরা নাখোশ হতে পারেন। এর অর্থ পত্রপাঠ খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানে বদলি।

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এই গণতন্ত্রচর্চা সম্ভবত বিএনপিকেও ‘উৎসাহিত’ করেছে। বিএনপির নেতাদের দাবি, তাঁরা রাস্তায় নামতে পারেন না। সরকার ও সরকারি দল তাঁদের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। তাঁদের এসব দাবি ভিত্তিহীন নয়। সরকার তাঁদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, তা-ও সত্য। তারপরও বিএনপির নেতা-কর্মীরা একটি গণতান্ত্রিক অধিকার অবাধেই চর্চা করে যাচ্ছেন—নির্বাচন এলেই মনোনয়ন নিয়ে দলীয় অফিসের সামনে শক্তির মহড়া দেখাচ্ছেন। শনিবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনের দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা-সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনায় ১২ জন আহত হন।

ওই দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভেতরে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার চলছিল। এ সময় মনোনয়নপ্রত্যাশী এস এম জাহাঙ্গীর ও এম কফিল উদ্দীনের সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এর আগে একই স্থানে ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। ইট ও লাঠির আঘাতে কয়েকজন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিতে ঢাকা-৫, ঢাকা-১৮, নওগাঁ-৬ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দুপুর থেকে গুলশান কার্যালয়ে মিছিল নিয়ে আসতে শুরু করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহম্মেদ এবং মহানগর উত্তর যুবদলের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন কয়েক শ সমর্থক নিয়ে কার্যালয়ের আসেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি বোর্ডের কার্যক্রম শুরু হয়।

মনোনয়ন নিতে আসা প্রার্থীদের সমর্থকদের মারামারিতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয় প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মনোনয়ন-বাণিজ্য বিএনপির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। এর আগে জাতীয় নির্বাচনের সময়ও দলীয় অফিসের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা শক্তির মহড়া দিয়েছিলেন। এতে দলীয় নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তাঁদের অনুগামীদের বোধোদয় ঘটেনি।

বিএনপির নেতারা প্রায়ই বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ বড়। কিন্তু তাঁদের অনুগামীরা যেভাবে পেশিশক্তির মহড়া দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাতে তাঁরা একটা কথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে দেশের চেয়ে দল বড়। আর দলের চেয়ে ব্যক্তি।

অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই, তারা পরস্পর দুই মেরুতে অবস্থান করছে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল আছে, দলের অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা হলে সেটি গায়ের জোরেই সমাধান করা।

১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলের কাছ থেকে গণতন্ত্রের এই ছবকটি নিতে পারে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।

[email protected]