গাজায় যুদ্ধবিরতি, কিন্তু তারপর

অস্ত্র সংবরণের পর হামাস ও ইসরায়েল দুই পক্ষই বিজয় দাবি করেছে

১১ দিন ধরে মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ২১ মে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। সংঘাতে মারা গেছে ৭০ শিশুসহ অন্তত ২৫৩ জন ফিলিস্তিনি। দুই শিশুসহ ১২ জন ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে। কয়েক হাজার রকেট ছুড়েছে হামাস, যার বড় অংশ ইসরায়েল আকাশেই ধ্বংস করতে পেরেছে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের বোমা আর কামানের গোলায় গাজায় ধ্বংস হয়েছে অন্তত দুই হাজার ভবন, যার মধ্যে স্কুল-হাসপাতালও রয়েছে। ক্ষতি হয়েছে আরও ১৫ হাজার বাড়িঘরের। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। নিখুঁত বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে আল-জাজিরাসহ অনেক গণমাধ্যমের অফিস ছিল এমন একটি বহুতল ভবন।

অস্ত্র সংবরণের পর হামাস ও ইসরায়েল দুই পক্ষই বিজয় দাবি করেছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের সামরিক ক্ষমতা বহুলাংশে নিঃশেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছে তারা। একই দাবি তারা ২০১৪ সালেও করেছিল। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া দাবি করেছেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হয়েছে এবং গাজার অভ্যন্তরে স্থলবাহিনী পাঠানোর সাহস পায়নি।

এবারই প্রথম নয়, আর এটাই যে শেষ, তা–ও কেউ বিশ্বাস করে না। ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালেও এমন ধ্বংসযজ্ঞ শেষে অস্ত্র সংবরণ হয়েছে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে গাজা থেকে রকেট নিক্ষেপ এবং তারপর ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ প্রচলিত প্যাটার্ন। ২০১৪ সালে সাত সপ্তাহের যুদ্ধে ইসরায়েলি স্থলবাহিনী গাজায় অভিযান চালিয়েছিল। খুব সুবিধা করতে পারেনি।

এবারের শুরুটা কিন্তু হামাসের রকেট হামলা দিয়ে হয়নি। পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ মহল্লা, যেখানে যুগ-জনম ধরে বংশপরম্পরায় কিছু ফিলিস্তিনি পরিবার বাস করে আসছে, তাদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করতে যায় ইজরায়েলি বাহিনী, ইহুদিদের জন্য বসতি নির্মাণের লক্ষ্যে। এ নিয়ে সংঘাত শুরু হয় ৩ মে। এরপর ৭ মে আল-আকসা মসজিদে পবিত্র জুমাতুল বিদার নামাজ পড়তে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের বাধা দেয় ইসরায়েলি পুলিশ, সংঘাতের ব্যাপকতা বাড়ে তাতে। ১০ মে রকেট-বোমার পাল্টাপাল্টি শুরু হয় এসবের পরিপ্রেক্ষিতে।

সংঘাত চলাকালে প্রত্যাশিত লাইনেই ছিল বিশ্বের প্রতিক্রিয়া। জাতিসংঘ মহাসচিব ইসরায়েলি বিমান হামলায় গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনি বিতাড়ন বন্ধের আহ্বান জানায় ইউরোপের কয়েকটি দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। প্রথমে তিনি ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র অধিকার আছে বলে বিবৃতি দেন, পরে ডেমোক্রেটিক পার্টির উদারপন্থীদের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মুখে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। ওআইসির ‘জরুরি বৈঠকে’ কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত হয়নি। সৌদি আরব সেখানে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করে। অনেক কষ্টে, অনেক বিলম্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হয় এই সংঘাত নিয়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সংঘাত বন্ধের উদ্যোগ নেন এবং এ নিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট এবং জর্ডানের রাজার সঙ্গে আলোচনা করেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকরে মিসরের প্রেসিডেন্ট মূল দূতিয়ালি করেছেন বলে জানা যায়।

যুদ্ধবিরতি তো হলো, এরপর কী? এবারের সংঘাত কি কোনো স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি পরবর্তী রাউন্ড কখন শুরু হবে, তারই অপেক্ষায় থাকবে সবাই? এ কথা প্রায় সবাই স্বীকার করেন যে গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ছাদবিহীন কারাগার। ইসরায়েল আর মিসর ২০ লাখ অধিবাসীর এই অঞ্চলকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে পরবর্তী সংঘাত সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সব সময় যেমনটা হয়ে থাকে, যুদ্ধবিরতির পর ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। ‘যুদ্ধবিরতি সংহত’ করতে মধ্যপ্রাচ্যে ঝটিকা সফরে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি এবং জর্ডানের রাজা মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেছেন। ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ে সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করার বাইরে গাজার পুনর্গঠনে কিছু অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শুধু। তাঁর বক্তব্যে দীর্ঘ মেয়াদে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ছিল পুরোই অনুপস্থিত।

এবারের সংঘাতকালে কয়েকটি অভিনব ঘটনা ঘটেছে। খোদ ইসরায়েলে বেশ কিছু স্থানে ইসরায়েলি আরব আর ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে। ইসরায়েলের লোকসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশই আরব। ইসরায়েলি পুলিশ কোনো কোনো জায়গায় কট্টরপন্থী ইহুদি তরুণদের ইসরায়েলি আরবদের ওপর আক্রমণ পরিচালনায় সহায়তা করেছে। এ রকমটি আগে তেমন দেখা যায়নি। পক্ষান্তরে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা করেছে। ন্যায়ের ভিত্তিতে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশে ফিলিস্তিনিদের প্রতি খানিকটা সমর্থন বাড়ছে। তারপরও ইহুদি লবিকে চটিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা বড়সড় কোনো শান্তি উদ্যোগ নেবেন, এটা আমার কাছে অতিপ্রত্যাশাই মনে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজা বা প্রেসিডেন্টরা রেজিম এবং পারিবারিক স্বার্থে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টিতে অক্ষম। হামাসের রকেট বা পশ্চিম তীরের অকার্যকর ফিলিস্তিনি প্রশাসনও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আনবে না। তুরস্ক, ইরান বা ইউরোপের সমর্থন খানিকটা ভূমিকা রাখতে পারে হয়তো। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে মূল সমর্থন আসতে হবে প্রগতিশীল ইহুদি জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ ইহুদিদের মধ্য থেকেই, সে ইসরায়েলেই হোক, অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সাম্প্রতিক সংঘাতকালে সে রকম লক্ষণ খানিকটা দেখা গেছে, আশার কথা সেটাই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে পত্র লিখেছেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কাছে। এর মধ্যে গোল বাধিয়েছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট। ‘ইসরায়েল ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের জন্য বৈধ’ বলে যে ঘোষণা পাসপোর্টে থাকত, সম্প্রতি ইস্যু করা ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট থেকে তা তুলে নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তটি ছয় মাস আগের হলেও সাধারণ জনগণ ও গণমাধ্যমের নজরে এসেছে এ সপ্তাহে। তাই ঠিক এ সময়ে কেন এ কাজ করা হলো, এ নিয়ে নানামুখী বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অদ্ভুত এক কারণ দেখিয়ে বলেছেন যে বৈশ্বিক মান অর্জনের জন্য এটা করা প্রয়োজন ছিল। তাহলে গত বছর ইস্যু করা ১০ বছর মেয়াদি ইলেকট্রনিক পাসপোর্টেও ‘ইসরায়েল ছাড়া’ কথা কটি লেখা ছিল কেন?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘ইসরায়েল নিয়ে আমাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সমর্থনও আগের মতোই অব্যাহত আছে।’ এটুকু পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের কেউ ইসরায়েলে যেতে পারবে না। কেউ গেলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইসরায়েলে যাওয়া যাবে না, এমন কোনো আইন আমাদের দেশে আছে বলে জানা নেই। আগে যাওয়া যেত না, কারণ পাসপোর্টেই সে কথা বলা ছিল। এখন, নতুন ইস্যু করা পাসপোর্ট স্পষ্টতই ইসরায়েলে যাওয়ার জন্যও বৈধ। আর কেউ যদি ইসরায়েলি ভিসা নিয়ে সেখানে যায়, তাকে আপনি ঠেকাবেন কী করে, আর তাকে শাস্তিই-বা দেবেন কী করে? শাস্তি দিতে গেলে যে আইন লাগবে, সে আইনই-বা কোথায়?

সবচেয়ে বড় কথা, কারণ ছাড়া তো কোনো কাজ করা হয় না। ইসরায়েলে গেলে যদি শাস্তিই দেওয়া হবে, তাহলে তো এই পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। তাইওয়ানকেও বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয় না, কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কিন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশিদের যোগাযোগ আছে। পাসপোর্ট নিয়ে বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে যাবে কদিন পর। আমার বিশ্বাস, এরপর তীর্থ দর্শন এবং ব্যবসাবিস্তারে কিছু কিছু বাংলাদেশি, সম্ভবত কোনো শাস্তির আশঙ্কা ছাড়াই ইসরায়েলে যাওয়া–আসা শুরু করবেন।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব