গ্লাসের অর্ধেক খালি, সাংবাদিককে সেখানেই নজর দিতে হবে

সাভারের গেন্ডামারা কেন্দ্রে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কিস্তির টাকা দেওয়া হচ্ছে।প্রথম আলো ফাইল ছবি

২০০৪ সালের কথা, দিনটি ছিল সোমবার, ১৯ জানুয়ারি। আমাদের পুরো দলটি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কক্ষে ঢুকলাম। উষ্ণ আতিথেয়তায় সবাই মুগ্ধ। এলান হুইটলি নানামুখী প্রশ্ন করলেন। তিনি বিরক্ত হলেন না। সব কটির জবাব দিলেন আন্তরিকভাবে। এলান ১৫ জানুয়ারি ঢাকা এসেছেন। তিনি রয়টার্সেরও এশিয়ার চিফ ইকোনমিক করেসপনডেন্ট। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের বাংলাদেশ চ্যাপটার আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছেন সিঙ্গাপুর থেকে। পাঁচ দিন থাকবেন। এই পাঁচ দিনের জন্য তাঁর সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত করে দেওয়া হলো।

এলান একজন ব্রিটিশ, তবে তাঁর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। উদার, খোলামেলা, বন্ধুপরায়ণ। তাঁর আচরণ এবং শব্দের উচ্চারণে আমেরিকান বলে ভুল করি। মৃদু হেসে বলেন, ‘সাত বছর কাটিয়েছি ওই দেশে। তাই ওদের এই দিকটা অজান্তে আমার মধ্যে নিষিক্ত হয়েছে।’ অধ্যাপক ইউনূস অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এলান হুইটলির জন্য সময় চাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি আগ্রহের সঙ্গে রাজি হলেন। বললেন, ‘আমি ওঁর কথা শুনেছি। তিনি খুব উঁচু মাপের সাংবাদিক।’ ভরাট কণ্ঠে প্রশ্ন করে করে নিজেকে আলোকিত করছিলেন এলান। আমি তাঁকে প্রথমে এলান বলে সম্বোধন করলাম। তিনি বললেন, ‘এই নামে আমাকে মা ডাকতেন। আর পেশাগতভাবে ডাকলে হুইটলি।’ আমি তা-ই করলাম। কিন্তু কী ভেবে তিনি বললেন, ‘নো, ইউ ক্যান কল মি এলান অ্যান্ড নো মিস্টার, এলান জাস্ট এলান।’ এভাবে আমরা আপন হয়ে গেলাম। তাঁর প্রশ্ন করার কৌশলটি আমি রপ্ত করার চেষ্টা করলাম। অনায়াসে প্রশ্ন করে ভেতরের খবর বের করতে হয়।

একটা অভিন্ন প্রশ্ন তিনি ড. ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ দুজনকেই করেছিলেন—কেউ যদি ভিক্ষা চায় আপনি কী করেন? গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস বললেন, ‘আমি খুব বিব্রত হই।’ অন্যদিকে আবেদ বললেন, ‘আমি তাকে সালাম জানিয়ে আমার না দেওয়ার ইচ্ছাটা প্রকাশ করি।’

কেন? ‘কারণ ভিক্ষা দেওয়া কোনো সমাধান নয়। বরং তাদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার এক গল্পে পড়েছিলাম এক কাঠুরেকে কুঠার দেওয়ার কথা। নবীজির কাছে এক ভিক্ষুক সাহায্য চাইলে তিনি তাকে এভাবে কাজ করে উপার্জনের পথ বাতলে দিয়েছিলেন।’

ক্ষুদ্রঋণের সুদ খুব বেশি, এ অভিযোগ সবার। ড. ইউনূস বললেন, ‘এই প্রশ্নটায় আমি কষ্ট পাই। আমি সমাজের সবচেয়ে বেশি অসহায় মানুষের দরজায় গিয়ে ঋণ পৌঁছে দিই। এই ঋণ তাদের স্বপ্ন দেখায়। আর সুদ বেশি যদি নিই, সেটা দিয়ে আমি কী করি? এই টাকা তো এই ব্যাংকেই থাকে। তারাই তো এই ব্যাংকের মালিক।’

প্রায় একই কথা বললেন ফজলে হাসান আবেদ। এক ঘণ্টার ওপর আমরা অধ্যাপক ইউনূসের সান্নিধ্যে কাটালাম। একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলাম। ছবি তুললাম। তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে এলান বললেন, ইতিহাসের পাতায় কমসংখ্যক মানুষ পদচিহ্ন আঁকতে পারেন। অধ্যাপক ইউনূস তাঁদেরই একজন। তিনি প্রকৃত অর্থেই বলতে পারেন যে তিনি লাখো মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। এলান হুইটলির এই মন্তব্য আমাকে আন্দোলিত করে। আমি তাঁকে একা পেয়ে প্রশ্ন করি, আমাদের জীবন কি তাহলে নিরর্থক? তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেন। বলেন, ‘অনেককে নিয়ে এই সমাজ। সমাজে যিনি যে পেশায় আছেন, সেই পেশায় থেকে অবদান রাখছেন। সেই অবদান অর্থময় করা দরকার। যেন তাতে মানুষের কল্যাণ হয়। এতে ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই।’ বললেন, ‘আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। এর মধ্যেই এ জগতের সার্বিক কল্যাণের জন্য আমাদের অনেক কিছু করতে হবে।’

ক্ষুদ্রঋণে বেশি উপকারভোগী নারীরাই
সৌজন্যে: ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন

পরের দিন ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের সাক্ষাৎকার। তিনি তাঁর বক্তব্যে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। যেমনটি আগের দিন করেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস ব্র্যাকের। এলান বললেন, ‘দেখেছেন বড় মাপের মানুষ কী রকম বিনয়ী? এই দুই ব্যক্তিত্ব আপনাদের জন্য বড় সম্পদ। আল্লাহ এঁদের সেরা হওয়ার গুণ দিয়ে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আবেদ বা ইউনূস কাউকেই আমি ছোট করে দেখতে পারছি না। তাঁরা দুজনেই নিজেদের জায়গায় নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছেন। ইউনূস খোলামেলা, প্রাণবন্ত। আবেদ মিতভাষী, বিনীত। দুজনেই মহীয়ান। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের জীবনকে তাঁরা অর্থময় করছেন।’ দুজনের কাছে এলানের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনাদের তৃপ্তি কোথায়?’ বললেন, ‘যখন দেখি গ্রামের এক অসহায় মহিলার চোখে জীবনের স্বপ্ন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।’ ‘আর অতৃপ্তি?’ জবাবে তাঁরা বললেন, ‘আমাদের আরও অনেক কিছু করার ছিল, কিন্তু পারিনি। নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা দেয়।’ এলানও বললেন একই কথা, ‘হ্যাঁ এখনো তো গ্লাসের অর্ধেকটা খালি। আর ওখানেই তো সাংবাদিক হিসেবে আমাদের নজর।’ আমি একা পেয়ে এলানকে বললাম, গ্লাসকে তো দুভাবেই দেখা যায়। এই যেমন অর্ধেকটা পূর্ণ আর সেটা দেখলে দোষ কোথায়? বললেন, ‘তাহলে কাজ থেমে যাবে। একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনাকে ওই খালি অর্ধেক নিয়েই কথা বলতে হবে। আঘাত করতে হবে।’

১৯ ও ২০ জানুয়ারি দুদিনই আমরা গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রকৃত উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ রকম একজন উপকারভোগী শাহনাজ বেগম। ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়। কী কষ্ট, কী দুঃখ! সেসব তাঁর এখন কেবলই স্মৃতি। এখন তিনি সচ্ছল। তাঁর বর্ণনা শুনে এলানের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে কেবলই তৃপ্তির ছটা। আমি তাঁর পাশে বসে সেসব দেখি। এক দুস্থ নারী তাঁর বড় হওয়ার কাহিনি শোনাচ্ছেন। আর তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনছেন। একপর্যায়ে তিনি বুড়ো আঙুল দিয়ে (থামস আপ) বিজয় উল্লাস প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে এই সংকেতটি পরিচিত নয়। তাঁকে যাতে ভুল না বোঝে সে জন্য আমি দ্রুত এই সংকেতের ব্যাখ্যা দিই। তিনি ওঁদের আপন হয়ে যান।

ড. ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের কাছে এলানের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনাদের তৃপ্তি কোথায়?’ বললেন, ‘যখন দেখি গ্রামের এক অসহায় মহিলার চোখে জীবনের স্বপ্ন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।’ ‘আর অতৃপ্তি?’ জবাবে তাঁরা বললেন, ‘আমাদের আরও অনেক কিছু করার ছিল, কিন্তু পারিনি। নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা দেয়।’

উঠে আসার আগে বললেন তাঁদের, ‘আমার জন্য কি আপনাদের কোনো প্রশ্ন আছে?’ শাহনাজ প্রশ্ন করলেন এলানকে, ‘আপনার মা-বাবা কী করেন?’ তিনি নিজের কাঁচা-পাকা দাড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘আমার তো অনেক বয়স হয়েছে। তাঁরা তো আর বেঁচে নেই।’ ‘কয় ছেলেমেয়ে আপনার?’ বললেন, ‘আমাদের সন্তান নেই।’ ‘কেন?’ জবাব দিলেন না, মৃদু হাসলেন। পরে আমি তাঁকে গাড়িতে ধরলাম। বললাম, যদিও ব্যক্তিগত তবু আমি জানতে চাই, কেন বাচ্চা নিচ্ছেন না? বিরক্ত হলেন না। বললেন, ‘আমি খুব স্বার্থপর। সময় দিতে পারব না। আমি এই জগৎটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই। আমি কখনোই দায়িত্বশীল পিতা হতে পারব না। আমাকে যে সারা বিশ্ব টানে। পেছনে ফিরে তাকানোর তাগিদ নেই, আছে হৃদয়ে, মস্তিষ্কে। একসময় হয়তো এই পেশাও আমাকে না টানতে পারে। আমি ফিরে যেতে পারি অধ্যাপনায়, আর দেশটা হতে পারে সে ক্ষেত্রে ফ্রান্স। কেবল লেখাপড়া। আমার মা-বাবার প্রথম শিক্ষিত সন্তান আমি। মা-বাবা দুজনের কেউই তেমন সচ্ছল ছিলেন না। এর মধ্যেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের পরিবারে আমিই প্রথম কলেজে গিয়েছি।’

আমরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাই। গ্রামের দৃশ্য, মানুষ, ছবি—সবকিছু এলানকে মুগ্ধ করছে। কিন্তু এক বাড়িতে এসে তিনি থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে বকরি ছাগলটা মারা গেছে। বাচ্চা প্রসব করার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা নিয়ে ছাগল কিনেছিলেন এক নারী। তিনটা বাচ্চা হয়েছে। নিথর শরীর নিয়ে পড়ে আছে মা ছাগল। বাচ্চারা তার পাশে নাচছে। কাঁদছেন ওই নারী। আমাদের দেখে তিনি আবৃত করলেন তাঁর শ্যামলা মুখ। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না তাঁর কান্না। আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। কী আশ্চর্য, শৈশব এসে হানা দিল আমার স্মৃতির পৃথিবীতে। আমার প্রতিবেশী রত্তন খাঁ চাচার হালের বলদ মরে গিয়েছিল। রত্তন খাঁর স্ত্রীকে আমরা চাচি বলে ডাকতাম। তাঁর কান্না গ্রামের নিস্তব্ধতাকে সেদিন আঘাতে আঘাতে চূর্ণ করে দিয়েছিল। এলান হুইটলি বললেন, ‘এই মৃত্যু কত বড় ক্ষতি এই পরিবারের জন্য তা আমরা বুঝতে পারছি না।’

*লেখক: বাংলাদেশে রয়টার্সের সাবেক ব্যুরোপ্রধান। বর্তমানে আমেরিকান চেম্বার জার্নালের নির্বাহী সম্পাদক।