ঘরহারা দুই এতিম শিশু এবং মধ্যরাতে জাগ্রত বিচার

জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। মধ্যরাতে কোর্ট ‘বসলো’।
ছবি: প্রথম আলো

জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। মধ্যরাতে কোর্ট ‘বসলো’। সত্যি সত্যি কিন্তু কেউ বসলো না। এর আগে মধ্যরাতে আদালত বসানোর কয়েকটি ঘটনা অবশ্য ছিল। ইনকিলাব পত্রিকা সংশ্লিষ্ট একজনের জামিনের ঘটনায় মধ্যরাতে আদালত বসেছিল। ৫ম সংশোধনীর রায়ের পরে ভীত বিএনপি মধ্যরাতে আদলত বসিয়ে হাইকোর্টের রায়ের স্টে নিয়েছিল। অন্য একটি ঘটনায় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির আদেশ রাত নয়টার দিকে স্টে হয়েছিল—ঠিক মধ্যরাতে নয়। আবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে উদ্ধারকাজের সময়ে সেখানে অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে মধ্যরাতে আদালত হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

এবারের ঘটনা ব্যতিক্রম। একদম নতুন নজির। একে ঠিক ভার্চুয়াল আদালতের রায়ও বলা যাবে না। এই ঘটনায় ফোনে ফোনে আদালত তার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। আর বহু বছর পরে আমরা মধ্যরাতে একটি নাটকীয় আদেশ পেলাম।

প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল কে এস নবীকে ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। ১৯৯৪ সালে আমার লেখা একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তা হিসেবে এসেছিলেন। তখন তিনি আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক। পরে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের অবসরকালীন জীবনে তাঁকে তাঁর বাসায় দেখেছি। তাঁকে সবসময় বিনম্র এবং মৃদুভাষী হিসেবে দেখেছি। কে এস নবীরা দুই ভাই। তাঁর নিজের দুই ছেলে। সবাই ব্যারিস্টার। তাঁর ভাই এবং দুই ছেলে সবাই সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

কে এস নবীর বড় ছেলে রেহান নবী ও ছোট ছেলে সিরাজুন নবী। ছোট ছেলে সিরাজুন (৪৪) গত ১০ আগস্ট দুই শিশুসন্তান রেখে মারা যান। তারা থাকতো কে এস নবীর ধানমন্ডির বাসায়। তাদের মায়ের সঙ্গে বাবা সিরাজুন নবীর বিচ্ছেদ আগেই ঘটেছিল। এখন বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের চাচা ব্যারিস্টার রেহান নবী দুই ভ্রাতুস্পুত্রকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মৃত ভাইয়ের সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ বোধগম্য। কিন্তু এই করোনাকালে এমন একটি নির্দয় কাজ করা কীভাবে সম্ভব হল, সেটা এক বিস্ময়। মানুষের মানবিকতা লোপ না পেলে, সমাজ যদি সত্যিই রসাতলে না যায়, তাহলে এমন ঘটনা তো ঘটার কথা নয়। বৈধতার প্রশ্ন থাকলে তা সুরাহার পথ এটা হতে পারে না।

জেনেছি, ১২ এবং ৯ বছরের দুই শিশু বাবার সঙ্গেই ছিলেন। বাবা মারা গেলে দুই শিশু মায়ের কাছে গিয়েছিল। গত পরশু ফিরে এলে চাচা তাদেরকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেননি। এ বিষয়ে থানা–পুলিশ করা হলে পুলিশকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, এর সুরাহা গতকাল (৩ অক্টোবর) দেবেন। কিন্তু সেটা ঘটেনি। এই বিষয়ে একাত্তর টিভি নাবালক শিশুর অধিকার নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেছিল। সেখানে দুই শিশুও ভিডিও–সংযোগে অংশ নেয়। অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদও ছিলেন সেই আলোচনায়।

এই আলোচনা টিভিতে দেখছিলেন একজন মাননীয় বিচারপতি। তিনি জানলেন, ওই শিশুরা তাদের বাসায় ঢুকতে পারছে না। কারণ তাদের ব্যারিস্টার চাচা তাদের বের করে দিয়েছে। এরপরই সুয়োমটো আদেশ দেন তিনি। সবটাই ঘটে ফোনে ফোনে। কোথাও কারো শারিরীক উপস্থিতি ছিল না।

আদালতের মৌখিক আদেশ সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান থানাকে ফোনেই অবহিত করেন। পুলিশ প্রশংসনীয় দ্রুততায় আদালতের আদেশ তামিল করে। মধ্যরাতে আদালতের আদেশদানের ইতিহাসে তাই এটি এক নতুন সংযোজন। এবং সেটা শিশুর সুরক্ষায়। এই ঘটনা একটি ভালো নজির হিসেবে অনাগত দিনগুলোতে আলোচিত হবে।

প্রথাগত কোনো হলফনামা লাগল না। টেলিফোনেই ঘটনা সম্পূর্ণ জেনে স্বপ্রণোদিত হয়ে শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে ওই আদেশ দিলেন বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ। রাত আড়াইটার দিকে দুই শিশুকে যথাযথ নিরাপত্তাসহ তাদের বাসায় তুলে দেয় ধানমণ্ডি থানা পুলিশ। এবং রাতে তারা সেই বাসার সামনে প্রহরায় নিয়োজিতও থাকে।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, ‘শনিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একাত্তর টিভির ‘একাত্তর জার্নাল’ টকশোতে তিন যুক্ত ছিলেন। আলোচনা শেষ হতে না হতেই তিনি ফোন পেলেন। জানলেন হাইকোর্ট একটি আদেশ জারি করেছেন। আদেশে ওই দুই শিশুকে তাদের বাসায় তুলে দিয়ে আসতে ধানমণ্ডি থানার ওসিকে নির্দেশ এবং একই সাথে এই আদেশ বাস্তবায়ন করে রোববার সকাল ১০টায় হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল।

দুপুরের পরে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ টেলিফোনে জানালেন, এফিডেভিট করে আদালতে এই বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার প্রস্তুতি চলছে। এখানেও কিন্তু কোন দৈহিক উপস্থিতির বিষয় নেই।

তাহলে আমরা দেখলাম যে শিশুর সুরক্ষায় আমাদের উচ্চ আদালত কতটা সংবেদনশীল হতে পারেন। এবং সামনের দিনগুলোতে আমরা একই ধরনের পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের কাছ থেকে অবশ্যই একই ধরনের আদেশ পাব; সেটা আশা করতে পারি। এই নজির আমাদের মনে তেমন আশার সঞ্চার ঘটায়। যদিও এটি এমন একটি ঘটনা, যেখানে দেশের একজন সাবেক এটর্নি জেনারেলের নাতি এবং একজন প্রয়াত ব্যারিস্টারের পুত্রদের স্বাস্থ্যহানির শংকার বিষয়ও জড়িত। কিন্তু যখন এই সুরক্ষা সাধারণ মানুষ পাবে, তখনই আইনের শাসনের যে সুষমা এবং শক্তি, সেটা মানুষ উপলব্ধিতে নিতে পারবে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে, কম অবস্থাপন্ন এবং দরিদ্র শিশুরা যদি এভাবে প্রভাবশালী চাচার মতো ব্যক্তির দ্বারা নিগৃহীত হতেন, অধিকারহারা হতেন, এবং তাদের পিতা যদি ব্যারিস্টার না হতেন, পিতামহ যদি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল না হতেন এবং টিভিতে যদি এরকম আলোচনা অনুষ্ঠান না হতো, তাহলেও কি এই রকমের আদেশ দেয়ার নজির তৈরি হতো?

আমরা অবশ্যই আশাবাদী থাকব এবং আমরা বিশ্বাস রাখব যে, বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ প্রদানের ক্ষেত্রে আইনের চোখে সমতার নীতি কার্যকর হবে।

আমরা জানতে পেরেছি দুই শিশুর ব্যারিস্টার চাচার বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা একাত্তর টিভি করেছিল। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। কিন্তু যে ঘটনা ঘটে গেছে তা কিন্তু তাঁর ‘বক্তব্য’ না–দেয়ার মধ্যে কিংবা শিশুদের তিনি আর তাড়িয়ে দেবেন না, এর মধ্য দিয়েই শেষ হবে না। তিনি যে উপায় অবলম্বন করেছেন, তাতে কোন রক্তের সম্পর্কের বন্ধন বিবেচনায় না হোক, শিশুর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন তা বিষ্ময়কর। ২০১৩ সালের শিশু আইনের লংঘন। ঘটনাটি শিশু আইনের ৭০ ধারার আওতায় খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। ভাই মারা যাওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহ না যেতেই তারা শিশু সন্তানরা আপন চাচার ‘‘হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায়’’ থাকবেন, সেটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা।

৭০ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘‘কোন ব্যক্তি যদি তাহার হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোনো শিশুকে উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ করার ফলে উক্ত শিশুর অহেতুক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’’

দৃশ্যমান এই নিষ্ঠুরতা বার কাউন্সিল প্রণীত আইনজীবীদের জন্য অনুসরণীয় যে আচরণবিধি রয়েছে, তার ব্যত্যয় বলে প্রতীয়মান হয়। আর যাই হোক সন্দেহাতীতভাবে এটা কোনও সদাচরণ নয়। সুতরাং বার কাউন্সিল এই আইনজীবীর অসদাচরণের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে। আদালত যেটা সুয়োমোটো করেছেন, সেটা সুয়োমোটো করার এক্তিয়ার বার কাউন্সিলের রয়েছে।

শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বার কাউন্সিল যদি এরকম এর একটি উদ্যোগ নিতে পারে, তাহলে তা আরেকটি ভালো নজির বলেই গণ্য হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।

[email protected]