ঘ্রাণে অর্ধভোজন এবং দারিদ্র্যসীমা বিতর্ক

বাব্বর বললেন, মুম্বাইতে এখনো ১২ রুপিতে একবেলা পেটপুরে খাওয়া যায়
বাব্বর বললেন, মুম্বাইতে এখনো ১২ রুপিতে একবেলা পেটপুরে খাওয়া যায়

কদিন ধরে একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক রগড় চলছে ভারতে, যা শুনলে কানের নিচে কষে দু-চার ঘা লাগাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এক অন্য প্রজাতির মানুষ। তাঁদের নাকি সাত খুন মাপ। তার ওপর তাঁরা যদি ভোটে-জেতা রাজনীতিক হন, তাহলে তো কথাই নেই। কানের নিচে লাগানো তো দূরের কথা, অমন ভাবাটাও অপরাধ। জনপ্রতিনিধিদের গায়ে হাত তোলার চিন্তা করার অপরাধে জেলখানায় যেতে হতে পারে। অতএব সে চিন্তা সরিয়ে রেখে রগড়টা বরং শোনানো যাক।
কংগ্রেসের নেতা রশিদ মাসুদ সেদিন বলে বসলেন, দিল্লিতে নাকি পাঁচ রুপিতে ভরপেট্টা খাওয়া যায়। মুখ ফসকে এমন উদ্ভট কথাটা তিনি বলে ফেলেছেন কি না কিংবা এক হাত জিব কেটে পরের দিন ওই কথাটা গিলে ফেলবেন কি না অথবা পাঁচের পেছনে একটা শূন্য কি আগে একটা এক বসাবেন কি না—এসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই পরের দিনটা এসে গেল এবং আমরা দেখলাম, চোরের সাক্ষী মাতালের মতো রশিদের কথার রেশ টেনে আরেক কংগ্রেস নেতা রাজ বাব্বর বললেন, মুম্বাইতে এখনো নাকি ১২ রুপিতে একবেলার পেটপুজো হয়ে যায়!
হঠাৎ কেন এমন সস্তায় খাওয়াদাওয়ার কথাটা উঠল, সেটার অবশ্য একটা পটভূমি আছে। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, কতটা খরচ করলে আপনি-আমি আর দরিদ্র থাকব না, তার একটা লাইন যোজনা কমিশন টেনে দিয়েছে। সেই লাইনটা হলো, আপনি যদি স্রেফ খাওয়ার জন্য দিনে ৩৩ রুপি ৩০ পয়সা খরচ করেন, মানে মাসে ধরা যাক এক হাজার রুপি, তা হলেই আপনি দারিদ্র্যসীমা টপকে গেলেন। এই লাইনটা গ্রামের মানুষদের জন্য অবশ্য আরেকটু নিচে। ২৭ রুপি ২০ পয়সা। সেই হিসাবে, শহরে পাঁচজনের এক সংসারের মাসিক আয় এবং খাওয়া খরচ যদি পাঁচ হাজার রুপি হয়, আর গ্রামে চার হাজারের কিছু বেশি, তাহলেই সেই পরিবার টুক করে দারিদ্র্যসীমার বেড়া টপকে ওপাশে চলে যেতে পারবে। যোজনা কমিশন এই কথাটা বলার পর জানায়, ২০০৪-০৫ সালে মনমোহন-সোনিয়া যুগলবন্দী যখন শুরু হয়েছিল, তখন দেশের যত মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, ২০১১-১২ সালে তার চেয়ে অনেক কম মানুষ এখন ওই সীমার নিচে থাকছে। সহজ-সরল মানেটা হলো, যুগলবন্দী ফাটাফাটি হিট। আর যে কথাটি ঊহ্য থাকল, তা হলো, এখনো যারা ওই লাইনটার নিচে আছে, খাদ্য সুরক্ষা আইন তাদের এক হ্যাঁচকায় টেনে তুলবে।
দিল্লিতে শীলা দীক্ষিতকে গো-হারান হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বিজেপির বিজয় গোয়েল। ভদ্রলোক প্রচারের স্বার্থে পারেন না এমন কিছুই নেই। যোজনা কমিশনের এই ঘোষণাটার পরদিনই তিনি ৩৩ রুপি ৩০ পয়সার চারটি মানি অর্ডার করলেন চার দিকপালকে। কারা সেই চারমূর্তি? প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ও যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া। বিজয় গোয়েল প্রত্যেককে একটা করে চিরকুটও পাঠালেন। তাতে লেখা, ‘অনুগ্রহ করে এই অর্থ খরচ করে দেখুন খিদে কতটা মেটে।’ ওই চিঠিটাই নড়েচড়ে বসিয়ে দিল কংগ্রেসের নেতাদের।
রশিদ মাসুদ ও রাজ বাব্বর মৌচাকে ঢিল মারবেন আর মৌমাছিরা ভনভন করে হুল ফোটাতে আসবে না, তাই কখনো হয়? বিশেষ করে, নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে? হইহই রইরই করে বিজেপি নেমে পড়েছে ময়দানে। ফি দিন একটা না একটা ফুট কাটছে তারা। কংগ্রেস রীতিমতো ব্যাকফুটে। সত্যিই তো, এই মাগগি গণ্ডার বাজারে দিনে ৩৩ রুপি ৩০ পয়সায় কীই-বা কেনা যায়? ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়লেন কপিল সিবাল ও দিগ্বিজয় সিংরা। কপিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানানোর ঢঙে জানতে চাইলেন, পাঁচজনের সংসারে মাসে পাঁচ হাজার রুপিতে কী করে চলতে পারে? কোন হিসাবে ঠান্ডা ঘরে বসে এমন কষ্টকল্পনার কাহিনি লেখা যায়? দিগ্বিজয়ও খড়্গহস্ত। গোটা বিষয়টিকেই ‘অবাস্তব’ আখ্যা দিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ড ঠিক করার পদ্ধতিতেই গোলমাল রয়েছে। মামলাটা সামলাতে গিয়ে তাঁরা কিন্তু বুঝলেন না, যে যোজনা কমিশনকে তাঁরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন, তাঁর ডেপুটির বস আসলে তাঁদেরই প্রধানমন্ত্রী। আরও বুঝতে চাইলেন না, তাঁদের আমলে তাঁদেরই কাছের দু-দুজন মানুষ অধ্যাপক টেন্ডুলকর ও অর্থনীতিবিদ অর্জুন সেনগুপ্ত দারিদ্র্যসীমার যে রেখা ঠিক করেছিলেন, তা ছিল আজকের বেঁধে দেওয়া অঙ্কর চেয়ে আরও কম। দেশ এগোচ্ছে, দারিদ্র্যসীমার রেখাও লম্বা হচ্ছে। আর এই লম্বা রেখাই তাঁদের সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণের সাফল্যকে মাথার ওপর তুলে ধরেছে। মন্টেকের শাপশাপান্ত করলেও তাঁর হিসাবের সারবত্তাকে কিন্তু তাঁরা অস্বীকার করলেন না।
যাকগে, এই রাজনৈতিক চাপান-উতোর থাক। দারিদ্র্য বা খিদে নিয়ে এসব চর্চা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। হয়তো শৈশব ও কৈশোরের সহনীয় দারিদ্র্যের ছোবল ও তার জ্বালা আজও ভুলতে পারিনি বলেই। সেই সব দিনে আমাদের সংসারে দারিদ্র্য ছিল, অনটন ছিল, অভাবও ছিল, কিন্তু চালহীন চুলোহীন দারিদ্র্যের সঙ্গে ঘর করতে হয়নি। অথচ সেই দারিদ্র্যও যে কী ভয়ংকর, তার রূপ আমার দেখা। সে কারণেই শহরে ৩৩ রুপি কি গ্রামে ২৮ রুপি নিয়ে অনর্থক বিতর্ক যখন সংবাদমাধ্যমে উথলে ওঠে, রসে-বশে থাকা মানুষেরা যখন নাড়ি-টেপা কবিরাজের মতো গম্ভীর মুখে দারিদ্র্য নিয়ে লেকচার দেন এবং দারিদ্র্যকে বেচে রাজনীতির সেতু বেয়ে ভোটের নদী পেরোতে চান, তখন আমার মনে পড়ে যায়, এই ভারত থেকে এক পয়সা, দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, সিকি ও আধুলি বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। এক টাকা এখনো প্রাচীন জমিদার বাড়ির মলিন দেউড়ির বাতির মতো টিমটিম করে জ্বলছে, যেকোনো দিন গুডবাই বলে কেটে পড়তে পারে। আরও মনে পড়ে, আমাদের চিরদুঃখী কলকাতায় ৩০ বছর আগেও ফুটপাতের পাইস হোটেলে পাঁচ সিকেতে ডাল-ভাত-ভাজা, ছয় সিকেয় মাছ-ভাত মিলত। আজও শিয়ালদা-হাওড়ায় ভিখারিদের ভাতের হোটেল রমরম করে চলে, কিন্তু ৫ বা ১২ রুপিতে ভরপেট্টা? শরীরটা রি রি করে ওঠে শুনে। কল্পনা করতে বেশ লাগে, কোনো সিনেমায় এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ জীবনের যুদ্ধে হেরে গিয়ে ৫ বা ১২ রুপির আবোল-তাবোল প্রলাপকারীর কলার চেপে কানের গোড়ায় শীর্ণ হাতের এক থাপড় কষিয়ে পরম তৃপ্তিতে জিব চাটছেন!
রশিদ মাসুদ বা রাজ বাব্বরদের জন্য করুণা হয়। কারণ, বাজি ধরে বলতে পারি, দুজনের কেউই নির্ভেজাল ‘শিব্রাম চক্কোত্তি’ পড়েননি, তাঁকে জানেনওনি। শিবরাম চক্রবর্তীর এই গল্পটা তাই তাঁদের জন্য, ভবিষ্যতে যাতে দারিদ্র্য বা খিদে নিয়ে লেকচার মারার সময় আরও কম খরচে পেট ভরার প্রেসক্রিপশন বাতলাতে পারেন।
শিবরাম একদিন সকালে আবিষ্কার করলেন, ঘরে মা ভবানী। কৌটো-বাটা ঢং ঢং করছে। একটা কানাকড়িও নেই। অথচ খিদে বড় বিষম বস্তু। কার কাছে হাত পাতা যায় ভাবতে ভাবতে দেয়ালের দিকে তাকালেন। সেখানে গাদাগুচ্চের ফোন নম্বর লেখা। ওটাই তাঁর চিরকালীন অভ্যাস; কারণ, ফোন নম্বর লেখা নোটবই হারাতে পারে, দেয়াল কখনো হারায় না। ধার পেতে পারেন, পাওয়াও হয়তো যাবে, কিন্তু কাঁহাতক আর ধার করে চালানো যায়? দেয়ালের দিকে তাকিয়ে এসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, কোনো রকমে সিআইএর এজেন্ট হতে পারলে তাঁর এই চিরদারিদ্র্য ঘুচে যাবে। কারণ, সিআইএর এজেন্টরা নাকি অনেক টাকা মাইনে পায়, দুহাতে টাকা ওড়ায়। কিন্তু কীভাবে ওদের খোঁজ পাওয়া যাবে? সিআইএর কোনো ফোন নম্বর তো তাঁর জানা নেই।
অতঃপর তিনি মেসবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। মনে মনে বললেন, সিআইএ এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান যখন, তখন নিশ্চয় তাদের একটা অফিস আছে। আর অফিস থাকলে তার সাইনবোর্ডও নিশ্চয় থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা পেরিয়ে ডালহৌসি স্কয়ার (তখনো তার নাম বিবাদি বাগ হয়নি)। আশ্চর্য, কোত্থাও কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়ল না। অথচ সূর্য মাথার ওপর উঠে ঢলে পড়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে কী-করি কী-করি ভাবতে ভাবতেই তাঁর মনে হলো, একবার আনন্দবাজারের অফিসে যাওয়া যাক। ওরা নিশ্চয় সিআইএর অফিসের ঠিকানা বাতলাতে পারবে। দু-একজন এজেন্টের খোঁজও হয়তো দিতে পারবে। হাজার হোক, খবরের কাগজ বলে কথা। সেই ভাবনামতোই ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত দেহ ও মন নিয়ে কোনোরকমে আনন্দবাজারের গলিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঢোকার মুখেই চাং ওয়ার (সেকালে কলকাতার সেরা চায়নিজ রেস্তোরাঁ) হেঁশেল-নির্গত রান্নার অপূর্ব সুঘ্রাণে তিনি মোহিত হলেন। বুকভরা ঘ্রাণ নিতে নিতে তিনি রাস্তায় বসে পড়লেন এবং বসা থেকে শোওয়া। শুয়ে শুয়ে শিবরাম বিস্ময় ভরে দেখলেন, কলকাতার হূৎপিণ্ড থেকেও এত চমৎকার এক দীর্ঘ আকাশ দেখা যায়!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই শয়ান শিবরামকে তুলে আনন্দবাজারে নিয়ে এসেছিলেন। আনন্দবাজারের শীতল অভ্যন্তরে বসে তাঁর প্রথম বাক্য, ‘চাং ওয়ার চায়নিজ খানা আমার আধখানা পেটে। এবার এক গ্লাস জল চাই।’
অভিজ্ঞ সুনীল চোখ কুঁচকে শিবরামের দিকে তাকালেন। ধরা পড়ে গিয়ে শিবরাম মলিন হাসলেন। ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম।’
রশিদ মাসুদ বা রাজ বাব্বররা আগামী দিনে বলতেই পারেন, বিনি পয়সায় আধপেটা খাবার যেকোনো ক্ষুধার্ত পেতেই পারেন। ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম।’
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।