চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হোক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নবীন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত—সবখানেই সেশনজট লেগে আছে। শিক্ষার্থীদের ছয় বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি ধরে হিসাব করলে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা পর্যন্ত সাড়ে ১৮ বছরের প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আরও ছয় মাস। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সেশনজট না থাকে, তাহলে সম্মান কোর্স শেষ করতে চার বছর আর স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে আরও এক বছর প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান ও স্নাতকোত্তর কোর্স পাঁচ বছরে শেষ করার ইতিহাস দুর্লভ। সেশনজট থাকার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে প্রায় আট বছরের প্রয়োজন হয়। কেউ যদি এক বছর ভালো কোথাও ভর্তি হতে না পারেন কিংবা রেজাল্ট খারাপ করার কারণে এক বছর নষ্ট হয়, তাহলে তাঁর পাঠ শেষ করতে প্রয়োজন হবে আরও এক বছর—মানে নয় বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যদি বয়স ১৯ বছর হয়, তাহলে পাস করার সময় তাঁর বয়স হবে ২৭-২৮ বছর। যাঁরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী থাকেন, তাঁদের আরও কয়েক মাস বেশি সময় প্রয়োজন হয়। সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর হওয়ার কারণে তাঁরা মাত্র দেড়-দুই বছর সময় পান। চিকিৎসকদের শিক্ষাজীবন বেশি দিনের হওয়ার কারণে তাঁদের আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যও ৩২ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সম্মান কোর্স তিন বছরের স্থলে চার বছর করা হলেও চাকরিতে আবেদনের প্রবেশকালীন সময় বৃদ্ধি করা হয়নি।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেশনজট অভিশাপের মতো। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একেক পরিমাণ সেই সেশনজট। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিচারে উচ্চশিক্ষা প্রসারে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। নামে জাতীয় হলেও যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশের বিষয়ে তারা জাতির কলঙ্কসম। যখন কোনো শিক্ষার্থী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না, তখন প্রথমত তাঁদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা ভাবার কথা। কিন্তু যখনই তাঁরা শোনেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পাস করতে আট বছর প্রয়োজন হবে, তখন তাঁরা মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থী রয়েছেন, তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের বহর বৃদ্ধি করে চলে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোয় সম্মান কোর্স খোলার কাজ দ্রুত চলছে। এরপর চলবে ইউনিয়ন পর্যায়ের কলেজে সম্মান কোর্স খোলার কাজ, তারপর গ্রাম পর্যায়ে।
দেশে কতজন শিক্ষার্থীকে সরকার ভর্তি করাতে পারল, তা তাদের কাছে রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে খুবই উপযোগী। তাদের যথাসময়ে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে পাঠ সম্পন্ন করা গেল কি না, তা বিবেচ্য নয়। উপাচার্য যান, উপাচার্য আসেন, কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কেউ বন্ধ করতে পারেন না। যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। কয়েক দিন আগে তো সম্মান কোর্সের ফল প্রকাশ না করেই স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় যত রকম অব্যবস্থাপনা থাকতে পারে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সবটিই সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী বের হন এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেশনজট বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন দেশের সবচেয়ে সেশনজটের আধারে পরিণত হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় খুলে তাদের অব্যবস্থাপনার কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসেনি এই আঞ্চলিক কার্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের জন্য শিক্ষার্থীরা কণামাত্র দায়ী নন। অব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী।
সেশনজটের কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মা-বাবা-ভাইয়ের দীর্ঘ পরিশ্রমের রেখা দীর্ঘতর হয়। শুধু তা-ই নয়, পাঁচ বছর চাকরিতেও পিছিয়ে যান তাঁরা। যে শিক্ষার্থী পাঁচ বছর আগে এমএ পাস করেন, তিনি পাঁচ বছর আগে চাকরির জন্য চেষ্টা করার সুযোগ পান। যখন বয়স বাড়তে থাকে, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ হয় না; অথচ চাকরিতে আবেদনের সময় পেরিয়ে যায়, তখন সরকারি কর্মকর্তা হতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণা কত গাঢ় হয়, তার খবর হয়তো আমরা কেউই রাখি না! যার আশৈশব বাসনা ছিল, একদিন বিসিএস কর্মকর্তা হবেন, তিনি হয়তো একবার চেষ্টা করার সুযোগ পান বিসিএস পরীক্ষায়। কেউ হয়তো পান না। এ অবস্থায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের কোনো না কোনো ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, যাতে বঞ্চিতজনেরা বিশেষ সুযোগ লাভ করেন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে চাকরির প্রস্তুতিমূলক লেখাপড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ইতিহাসে পাস করে ব্যাংক কর্মকর্তা, আবার প্রকৌশলী হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হন। চাকরির জন্য যে লেখাপড়া করতে হয়, তার জন্য আলাদা করে প্রস্তুতিমূলক সময়ের প্রয়োজন হয়। যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে করেন, তাহলে তিনি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সময়ই পান না।
উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন সংকট। সরকারি চাকরির বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ করার কারণে সরকারি চাকরির উচ্চপদে দুই বছর কেউ অবসরে যাচ্ছেন না। উচ্চপদ শূন্য না থাকলে চাকরিতে প্রবেশকালীন পদগুলোও শূন্য হবে না। দুই বছর নতুন পাস করা শিক্ষার্থীরা অনেকাংশে বঞ্চিত হবেন। বর্তমানে দীর্ঘদিন সেশনজটে থাকা শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ করার জন্য আন্দোলন করছেন। যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে ২৭-২৮ বছরে স্নাতকোত্তর পাস করছেন, তাঁরা বর্তমানে যে দাবি নিয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্য এ দাবি একেবারে অযৌক্তিক নয়। যখন সম্মান কোর্স ছিল তিন বছরের, এত জট ছিল না এবং চাকরির বয়স ৫৯ হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল না, তখনই ৩০ বছর ছিল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। এখন মোট শিক্ষাবছরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক বছর, অবসরের সময়সীমা বৃদ্ধির কারণে যুক্ত হয়েছে দুই বছর এবং সেশনজট বেড়েছে অতিমাত্রায়। এ পরিস্থিতির যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁদের দাবি যৌক্তিক। তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা মূল্যায়ন করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বয়সসীমা ৩৫ না হলেও সাধারণদের জন্য ৩২ এবং চিকিৎসকদের জন্য ৩৩ করা যেতে পারে। যদিও প্রবেশসীমা বৃদ্ধি কোনো সমাধান নয়, তদুপরি বঞ্চিত ব্যক্তিদের কথা বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে নির্দিষ্ট একটি সময় বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন, যে সময়ের মধ্যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে হবে। তা না হলে সেশনজট দূর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]