চামড়াশিল্পের উত্থানের সুযোগ ফের বেহাত হবে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক চামড়াবাজার নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। সুযোগের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও। চীনের বাজার এই খারাপ সময়েও চালু ছিল। দুনিয়ার ট্যানারি শিল্প যখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ রেখেছে, তখন ইউরোপের এই কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীন। ইতালি-ভারত ইত্যাদি দেশের চামড়াশিল্প সংকটে। তখন বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া পণ্যের বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে করোনা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে। সুযোগের সেই ফল হাতে তুলে নেওয়ার আয়োজন তো দেখা যাচ্ছেই না, বরং দেখা যাচ্ছে উল্টো গতি।

২০২০ সালের কোরবানি ঈদের পর আগের বারের মতোই আবহাওয়া চরম গরম। কাঁচা চামড়ার জন্য এটা অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও কাঁচা চামড়ার মূল্যপতনের ফলে লবণ লাগানোর খরচ উটকো বলে গণ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে লবণের চেয়ে চামড়ার মূল্য কম। ছাগলের চামড়ার প্রায় শূন্য মূল্যের কারণে লবণ দেওয়া বন্ধ করেছে আড়তদারেরা। সরকারের উচিত ছিল সাভারে জরুরি ভিত্তিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা করা।

কাঁচা চামড়ার বড় আন্তর্জাতিক উৎস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রায় ধরাশায়ী। এসব দেশের পশুসম্পদ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯-মুক্ত ‘কাঁচা চামড়া’ সনদ নিয়েও বিতর্ক আছে। ভারতে রাজনৈতিক কারণে চামড়ার বাজার স্থায়ী হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। অন্য কারণেও ভারতের চামড়াশিল্প অভাবনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত। গো-সুরক্ষা ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বিতা এই খাতে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাসায়নিক কাঁচামাল আমদানির বেলায় ‘নন-পেমেন্ট’ প্রথার ফলে এরা অবিশ্বস্ততার অলিখিত ‘সনদপ্রাপ্ত’ হয়েছে। কিছু ভারতীয় কোম্পানি নিম্নমানের দেশীয় রাসায়নিক ব্যবহার করছে। ফলে ,কমপ্লায়েন্স নিয়েও ভারতের সংকট স্থায়ী হতে পারে। চীনের সঙ্গে বিরোধ ভারতীয় বাজারে মন্দা ভাবের সৃষ্টি হবে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো তাদের জন্য কঠিন। দুনিয়াব্যাপী চামড়াজাত কার সিট, আপহোলস্ট্রি (সাজসজ্জার উপকরণ) বাজারের উঠে দাঁড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব। কারণ, গাড়ির বিক্রি প্রায় ৫০ ভাগ কমে এসেছে।

ইতালি করোনায় যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে ফ্যাশন হাউসের কাজ ছাড়া জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ কমে যাবে। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার বড় মাপে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা উৎপাদকেরা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলে, ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাশন শিল্প আর চীনের সমন্বয়ে চীনভিত্তিক এক বিশাল চামড়া, ফুটওয়্যার, চামড়াজাত পণ্যের বাজার বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বাংলাদেশ হতে পারে সেই বিশ্ববাজারের অন্যতম শরিক। উল্লেখ্য, চীনের বাজার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আট হাজারের ওপর পণ্যের ওপর থেকে ৯৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এসব বিষয় মাথায় রেখে বাংলাদেশকে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন ১. কাঁচা চামড়ার চোরাচালান বন্ধ করা, ২. চামড়ায় মুল্য সংযোজন করা ও বাজারজাত করার নীতি নেওয়া। এ দুটি কাজ করা গেলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বর্তমানের প্রায় ১০ গুণ! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চামড়া পণ্য উৎপাদকদের ‘রপ্তানি গিল্ড’ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এরা নিম্নতম মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেনতেন মূল্যে চামড়া বিক্রয়ের রাস্তা থেকে সরে আসাই হবে এই খাতের মূল লক্ষ্য। কস্ট ম্যানেজমেন্ট করে ৬০ থেকে ৭০ সেন্টে চামড়া বিক্রি করাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

গৌরবের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু বাস্তবে এক দশক ধরেই এই খাত পতনশীল; শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় আর দুর্নীতির শিকার হয়ে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ বাজার পতন হয়েছে। ২০১৩-১৪ সাল থেকে এ খাতের আয় ১ দশমিক শূন্য ৮ থেকে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। অন্যদিকে, ভারতের ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের বিপরীতে চীনের আয় ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান করছে ৯৪৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালকে চামড়া বর্ষ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চামড়াশিল্পের পতন সেই সময় থেকেই শুরু। শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতি সপ্তাহে বৈঠকের কথা! কিন্তু যাঁরা ট্যানারি চালাবেন, তাঁদের এত সময় নেই। আর যাঁরা প্রতি সপ্তাহে মিটিং চালাবেন, তাঁদের শিল্প চালানোর সময় নেই—এটাই বাস্তবতা।

বাংলাদেশ ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়া উৎপাদন করে। প্রক্রিয়াজাত চামড়া, জুতা, চামড়াজাত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হয় ১৪০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন বর্গফুট। শুধু নতুন এলাকা সাভারের সামগ্রিক উৎপাদন ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন বর্গফুট ধরা হয়েছে। ১৫৫টি ট্যানারির অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানে, যাদের অধিকাংশের এক প্রজন্মের তো দূরের কথা কস্মিনকালেও চামড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। শুধু হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের নিবন্ধন থাকার সুবাদে এখানে জমি বরাদ্দ পেয়েছে অনেকে। তাদের অনেকেই সুযোগটাকে শুধু রিয়েল স্টেট ব্যবসা হিসেবে দেখছে। সাভারে শিল্প স্থানান্তর সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো, ইটিপি স্থাপনা নিয়ে যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, তা পিছিয়ে দিয়েছে বাজারকে। বেশ কিছু ক্রেতা ভিয়েতনাম ও এশিয়ার অন্যত্র উৎপাদকের খোঁজ করছে।

তারপরও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তার জন্য পুরো ট্যানারি খাতকে ৫০ থেকে ৬০টি শিল্পে নামিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। প্রতিযোগিতামূলক দরপতন কমানো সম্ভব এভাবেই। একইভাবে জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য শিল্পের সংখ্যাও ৬০ থেকে ৭০-এ নামিয়ে আনা দরকার। বিশ্ববাজারের ধারা পরিবর্তিত হবে এবং প্রাকৃতিক পণ্যের বাজার বিকশিত হবে। এর আগাম প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? কোনো একটি খাতের উন্নতি সেই খাতের পরিচালকদের যৌক্তিক সততার ওপরও নির্ভরশীল। এই খাতের নামে ঋণ নিয়ে লুটে নেওয়াদের তাই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে ট্যানারিজাত হয়ে জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই খাতের সঙ্গে জড়িত। এই খাতে যে অভিজ্ঞতা, দক্ষ শ্রমিক ও কর্মী তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে শক্তির জায়গা। বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্প মাত্র ৫ বছরেই ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্তরে উঠতে পারে, যদি:

১. আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তিনির্ভর খাত হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়। টেকসই প্রযুক্তি মানে পানি ও রাসায়নিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া। পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা চালু রাখা।

২. ট্যানারি শিল্পের মালিকদের সমন্বয়ে রপ্তানি গিল্ডের ‘প্রাইস সেন্টার’ গঠন করা। তাঁদের প্রধান কাজ হবে চামড়ার ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা। কোনো ট্যানারি এই মূল্যের নিচে চামড়া বিক্রি করলে তার রপ্তানি ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা। রপ্তানির ক্ষেত্রে এই ‘রপ্তানি গিল্ডের’ সনদ বাধ্যতামূলক করা।

৩. ক্রমান্বয়ে সব রপ্তানিমুখী ট্যানারির জন্য এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থার সনদ) কমপ্লায়েন্স বাধ্যতামূলক করা।

৪. ট্যানারি শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা ও মানবিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা।

৫. ‘বায়ারস ইনসেনটিভ’ হিসেবে আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফ্লাইট কস্ট ও হোটেল ভাড়ার ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্যাশব্যাকের ঘোষণা দেওয়া।

৬. কাঁচা চামড়া ও কেমিক্যাল আমদানি ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যার হাউসের পাশাপাশি সব বাণিজ্যিক ও শিল্প আমদানিকারকের জন্য কনসলিডেটেড ১০ শতাংশ মোট ট্যাক্স নির্ধারণ করা—যাতে সব ধরনের শিল্প প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে রাসায়নিক কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে।

৭. ব্যাংকঋণের মধ্যে স্বচ্ছতা আনা।

সর্বোপরি ট্যানারি খাত ও সরকারের যৌথ নীতি গ্রহণ করতে হবে, যার স্লোগান হবে ‘লক্ষ্যমাত্রা ১০ বিলিয়ন’।

আহাদ আহমেদ: চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তা।