চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক যেভাবে উন্নত করা যায়

চিকিৎসক সযত্নে রোগী দেখছেনছবি প্রথম আলো

আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সব সময়ই আলোচনায় ছিল। কোভিড-১৯ মহামারিকালে এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। হাসপাতাল, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে রোগীর অনেক প্রত্যাশা যেমন থাকে তেমনি অনেক সময় রোগী হতাশও হয়ে থাকেন। এই প্রত্যাশা-হতাশার মধ্যেও চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে মমতা ও পারস্পরিক নির্ভরতাও জন্মে।
চিকিৎসা সেবার মূল হলো চিকিৎসক। তাই আমরা যত আধুনিক প্রযুক্তি, সুবিধা, আতিথেয়তা দিই না কেন, চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়া, নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা, মমত্ববোধ যদি সম্মানজনক অবস্থায় না আনা যায়, তাহলে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। কিছু বিশেষ দিক পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে আলোচনাটা আরও সহজবোধ্য হবে।


রোগীর প্রত্যাশা ও অধিকার
একজন রোগী হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যখন আসেন তখন তিনি অনেক কষ্ট-ব্যথা, অসুস্থতা নিয়ে আসেন। পাশাপাশি বেশ কিছু খরচের সম্মুখীন হন। রোগী চিকিৎসকের কাছে অনেক আশা নিয়ে আসেন, চিকিৎসক তাকে অগ্রাধিকার দেবেন, পর্যাপ্ত সময় ধরে দেখবেন, কথা বলবেন, তাঁর কী হয়েছে তা বুঝিয়ে বলবেন, রোগীর গোপনীয়তাও যথাযথভাবে রক্ষিত হবে এবং ভবিষ্যতে শারীরিক অসুস্থতার সময় ওই চিকিৎসককে তিনি পাবেন—সাধারণত সব রোগীরই এসব প্রত্যাশা থাকে।


একজন চিকিৎসকের কাছে অনেক রোগী আসেন। তিনি প্রতিদিন অনেক অসুস্থ মানুষকে দেখেন, চিকিৎসা করেন এবং সুস্থও করেন। রোগী চিকিৎসকের জন্য যখন অপেক্ষা করেন, তখন মনে অনেক আশা থাকে। সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন থাকে এবং এটাও ভাবেন, ওপরওয়ালার নির্দেশে চিকিৎসকই তাকে ভালো করে দেবেন। রোগীরা বিশ্বাস করেন, চিকিৎসকের চিকিৎসার ওপর সুস্থ হওয়া না–হওয়া নির্ভর করে।

অধিকারের প্রশ্ন যখন আসে, তখন রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চিকিৎসকের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া, রোগ ও এর চিকিৎসা এবং খরচ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া এবং সম্মানজনক আচরণ পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রোগীর রয়েছে। রোগীদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে, অধিকার রক্ষায় সহিংসতা বা ঔদ্ধত্য কোনো সুফল আনে না বরং সচেতনতা ও নিয়মতান্ত্রিক চর্চাই ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

রোগীর কাছে চিকিৎসকের প্রত্যাশা ও অধিকার
চিকিৎসকও একজন মানুষ। তিনি প্রতিদিন ২০-২৫ জন অসুস্থ মানুষকে বহির্বিভাগে দেখেন। আন্তঃবিভাগেও ১০-১২ জন রোগী দেখেন। ক্ষেত্রমতো তিন–চারজনের অস্ত্রোপচার করেন। কোনো কোনো রোগী কিছুটা কম আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকেন; কিছু রোগী থাকেন সংকটাপন্ন। আবার চিকিৎসকের নিজের পরিবার আছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা আছে। তিনিও মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন, অসুস্থ হতে পারেন এবং সে অবস্থায়ও তাঁকে রোগী দেখার কাজ করতে হয়।


তাই চিকিৎসকেরও প্রত্যাশা রোগী সময় মতো এবং পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে আসবেন। রোগ সম্পর্কিত কথা বলবেন এবং পরিমিত কথা বলবেন, প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবেন এবং কোনো কিছুই লুকাবেন না। চিকিৎসক যা বলবেন তা শুনবেন, পরবর্তী সময়ে সাক্ষাতের সময় অনুযায়ী এসে স্বাস্থ্যের হাল নাগাদ অবস্থা জানাবেন এবং ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ–পথ্য খাবেন।


চিকিৎসকদের মাঝেমধ্যে জরুরি কিছু রোগী এসে যায় অথবা অস্ত্রোপচার কক্ষে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। তাই চিকিৎসকেরা কখনো কখনো রোগীকে দেওয়া সময় অনুযায়ী আসতে পারেন না। অনেক সময় এ নিয়েও চিকিৎসক–রোগীর মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।


কী হওয়া উচিত
সেবা দেওয়া ও সেবা নেওয়া পরস্পর–সম্পর্কিত বিষয়। সেবা দানকারী যদি পূর্ণ সাহায্যকারী মনোভাবসম্পন্ন হন, তাহলে সেবা গ্রহণকারী আরও বেশি উপকৃত হবেন। চিকিৎসক যেহেতু কাগজে–কলমে সম্মানী নিয়ে সেবা দিচ্ছেন, তাই তাদের সাহায্যকারী মনোভাবসম্পন্ন হওয়ার কথা। রোগীদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু অধিকার রয়েছে এবং চিকিৎসকদেরও পেশাদার আচরণের কিছু দিক–নির্দেশনা রয়েছে। চিকিৎসক সমাজকে এসব অধিকার ও দিকনির্দেশনার প্রতি সম্মানবোধ রেখেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। সহানুভূতিশীল এবং দায়বদ্ধ চিকিৎসকই পারেন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে।


চিকিৎসকদের যা করা উচিত: সময়মতো রোগী দেখা শুরু করা; একজন রোগীকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দেখা; ওই সময় টেলিফোন, মোবাইল বা অন্য বিষয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা; রোগীর রোগ সম্বন্ধে গোপনীয়তা রক্ষা করা; রোগীকে সময় নিয়ে দেখা এবং শারীরিক পরীক্ষা করা; রোগী অথবা রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের রোগ সম্বন্ধে অল্প সময়ে বিস্তারিত বুঝিয়ে দেওয়া; পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কোনো প্রক্রিয়া বা অপারেশনের প্রয়োজন হলে তা বুঝিয়ে বলা, যাতে রোগী প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটি যথাযথভাবে বুঝতে পারেন; খরচের ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেওয়া; রোগীকে মানসিক চাপ থেকে বের করে আনা।

চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকরা নিশ্চিয়ই নিজস্ব অবস্থান থেকে আরও বেশি আন্তরিক হবেন, রোগী দেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময় হাতে রাখবেন এবং ইতিবাচক আচরণ ও কথাবার্তার মাধ্যমে রোগীর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবেন। তাহলে চিকিৎসকের বিষয়ে রোগীর আস্থা বাড়বে।


যেহেতু রোগী বা রোগীর স্বজন অসুস্থতার সময় মানসিক চাপের পাশাপাশি আর্থিক চাপের মধ্যে দিয়ে যান, তাই মাঝে মাঝে তাঁরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। তখন যথাসম্ভব তাঁদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও চিকিৎসকের দায়িত্ব।
অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাকে সহযোগিতার জন্য সহকারী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবিকা, সহকারী রাখেন, তাঁরা ওপরে বর্ণিত অনেকগুলো কাজ করে থাকেন। তবে রোগী কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেই চিকিৎসা নিতে আসেন। তাই চিকিৎসক তাঁকে পর্যাপ্ত সময় দেবেন এবং কিছুটা হলেও ওপরের কাজগুলো নিজ হাতে করবেন এমনটাই রোগীর আশা থাকে এবং এটা রোগীর অধিকারও বটে।


রোগীর যা করণীয়: রোগী যথাসময়ে আসবেন। বিশেষ জরুরি না হলে কিছু সময় অপেক্ষা করবেন; রোগী সঠিকভাবে শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে ও অসুবিধার কথা বলবেন; শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা, রোগের ইতিহাস নেওয়ার সময় চিকিৎসককে সহায়তা করবেন এবং মনোযোগী থাকবেন; পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পূর্ববর্তী নির্দেশনা থাকলে তা অনুসরণ করবেন; কোনো বিষয় না বুঝে থাকলে চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবেন; পরবর্তী সময়ে ফলো আপ ভিজিটে আসবেন। প্রয়োজন ছাড়া চিকিৎসককে অযথা ঘন ঘন মোবাইল, টেলিফোন ও যোগাযোগ করবেন না। এ কাজটি চিকিৎসকের নিয়োগ প্রদানকারী বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমেও করা যেতে পারে; ব্যতিক্রমী কারণ ছাড়া চিকিৎসকের ওপর সাধারণভাবে আস্থা রাখবেন এবং সমস্ত পরামর্শ মেনে চলবেন। কোনো কারণে আস্থা না থাকলে চিকিৎসক পাল্টাবেন।


২০০০ সালের পর বাংলাদেশে বেশ কিছু আধুনিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার হয়েছে, যেখানে বিদেশের মতো উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় এবং প্রায় সকল আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুবিধাদিও পাওয়া যায়। কিন্তু এখন বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। চিকিৎসক–রোগীর সম্ভাব্য বিরোধ এড়াতে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে ন্যায়পাল নিয়োগের কথা ভাবতে পারে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিল সম্ভাব্য বিরোধ এড়াতে সকল পক্ষের জন্য দিকনির্দেশনা দিতে পারে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব প্রতিপালন নিশ্চিত করতে পারে।
প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়, চিকিৎসকরা পর্যাপ্ত সময় দেন না। বেশি পরীক্ষা–নিরীক্ষা দিয়ে থাকেন। কিংবা প্রয়োজনের সময় চিকিৎসক পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে কিছু চিকিৎসকের কাছে অনেক রোগী আসলেও অনেক চিকিৎসক তেমন রোগী পান না। আবার রোগীর চাপ সন্ধ্যায় অনেক বেশি হলেও সকালে তেমনটি থাকে না। এক্ষেত্রে শৃংখলা আনা জরুরি।
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকরা নিশ্চিয়ই নিজস্ব অবস্থান থেকে আরও বেশি আন্তরিক হবেন, রোগী দেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময় হাতে রাখবেন এবং ইতিবাচক আচরণ ও কথাবার্তার মাধ্যমে রোগীর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবেন। তাহলে চিকিৎসকের বিষয়ে রোগীর আস্থা বাড়বে। পাশাপাশি রোগী ও তাদের স্বজনরা যদি চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, চিকিৎসকরা যে মানসিক এবং সামাজিক চাপে থাকেন, তা বিবেচনায় রাখেন, তাহলেই গড়ে উঠবে একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক।
চিকিৎসক রোগীকে দেখলে রোগী সুস্থ হয়ে যাবেন, শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, চিকিৎসা সেবার আস্থাহীনতা কাটাতে রোগী ও চিকিৎসকের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একটি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গঠনে প্রধান সহায়ক হবে।


ডা. এ এম শামীম : ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক