চীন-ভারতের ব্যবধান অলিম্পিকের মতো বড়

ভারত ও চীনের ব্যবধান টোকিও অলিম্পিকে দুই দেশের পদক সংখ্যার পার্থক্যের মতোই

টোকিও অলিম্পিক গেমস মাত্রই শেষ হলো। যে এলাকায় অলিম্পিকের ভেন্যু ছিল, সেখানে খেলা চলাকালে কোভিড-১৯–এর প্রকোপ বা অন্য কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়নি বলে গোটা কর্মসূচি ভালোয় ভালোয় শেষ করা গেছে। এ জন্য জাপানের সরকার ও সাধারণ মানুষ স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে। আমার দেশ ভারত এই গেমসে প্রথমবারের মতো বর্শা নিক্ষেপে সোনা জিতেছে। সে জন্য এখানকার মানুষ এই সুসংবাদটিকে নানাভাবে উদ্‌যাপন করেছেন। সেই উদ্‌যাপনের রেশ এখনো কাটেনি। কিন্তু আমাদের কাছে যেটি সর্বকালের সেরা, আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে আদতে সেই ‘সেরা’ আসলে কতটা সেরা, তা ভেবে দেখতে হবে।

মাত্র এক দশক আগেও অনেকেই ভারত ও চীনকে প্রায় সমান সমান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করত। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর পরপরই এই দুটি দেশকে প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো। এমনকি অনেকে চীন ও ভারতের শক্তি যদি এক হয়, তাহলে সেই সম্মিলিত শক্তির নাম ‘চিন্ডিয়া’ হবে বলেও মন্তব্য করতেন।

কিন্তু ভারত ও চীনকে একই মাপের শক্তি হিসেবে যাঁরা দেখে থাকেন, তঁাদের শুধু টোকিও অলিম্পিকের পদকগুলোর টালি খাতা দেখলেই বোঝা যাবে। এখানে দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অল্প কয়েকটি কম পদক পেয়ে চীন দ্বিতীয় অবস্থানে এসেছে। চীন ৩৮টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৮৮টি পদক জিতেছে। এরপর নিচের দিকে আছে বেলারুশ, বিভক্ত জর্জিয়া, বাহামা দ্বীপপুঞ্জ। এমনকি যে কসোভোকে ভারত আজও দেশ হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি, তারাও ভারতের ওপরের সারিতে আছে। একটি সোনা, দুটি রুপা এবং চারটি ব্রোঞ্জ—এই মোট সাতটি পদক জিতেছে ভারত।

আসলে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, অনেক বছর চীন এই বৈশ্বিক অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর আবার সেখানে যুক্ত হয়েই অলিম্পিকে সাফল্য পাওয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অন্যদিকে ভারত খেলাধুলায় তার ঘাটতি থাকার পরও আত্মতুষ্ট থেকে এসেছে।

অলিম্পিক গেমসে চীন ফেরার দুই দশক পর চীন অনেক তদবির করে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের স্বাগতিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু দিল্লিতে ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমস আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারত আত্মতুষ্টি নিয়ে পড়ে আছে। অলিম্পিক গেমসে ভারতের অন্তর্ভুক্তি হয়েছে চার দশক আগে। কিন্তু নিজের মাটিতে অলিম্পিক গেমস আয়োজন করার সম্ভাবনা এখনো ভারতের জন্য সুদূরপরাহত।

চীন ‘প্রজেক্ট ১১৯’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। আগ্রাসী কায়দায় অলিম্পিক মেডেল অর্জনে উৎসাহিত করতে তারা এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ২০০০ সালে সিডনিতে যে অলিম্পিক গেমস হয়েছিল, তাতে স্বর্ণপদকের সংখ্যা ছিল ১১৯টি। সব কটি মেডেল ছিনিয়ে নেওয়ার স্পৃহা জাগাতে চীন সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। অন্যদিকে, ভারত সব মিলিয়ে ১০টি পদক পেলেই আত্মহারা হয়ে যায়।

চীন সরকার যদি চায় তারা ছয় লেনের একটা এক্সপ্রেসওয়ে করবে, তাহলে তারা প্রয়োজনে রাস্তার জায়গা বের করার জন্য রাতারাতি কয়েকটি গ্রাম গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ভারতে যদি দুই লেনের একটি রাস্তা চওড়া করার কোনো পদক্ষেপ নেন, তাহলে দেখবেন হয়তো জমির মালিকেরা ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা ঠুকে দিতে পারেন। তা নিয়ে ফয়সালায় আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।

চীন তার লক্ষ্য অর্জনে, অর্থাৎ সর্বোচ্চসংখ্যক পদক জেতার জন্য শ্রেষ্ঠতম ক্রীড়াবিদদের কোচ হিসেবে নিয়ে তাদের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষিত করেছে। চীনের খেলোয়াড়েরা যে যে খেলা ভালো খেলে, তারা সেই সেই খেলা অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর তদবির করেছে এবং অনেক খেলা সেখানে অন্তর্ভুক্তও করেছে। কিন্তু ভারতের এ দিক থেকে একেবারেই আগ্রহ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত কাবাডি খেলায় অনেক ভালো করে থাকে। এ ছাড়া পোলো এবং ক্রিকেট খেলাও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তারা চেষ্টা করে থাকে। ১৯০০ সালে একবারই অলিম্পিকে ক্রিকেট খেলা হয়েছিল। এরপর আর কখনোই ক্রিকেট এখানে খেলা হয়নি। ভারত যেহেতু এই খেলাগুলো ভালো পারে, সে জন্য তারা এগুলো অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তাতে তারা গা করে না।

এ ছাড়া চীন শুটিংয়ের মতো কিছু নন–ট্র্যাডিশনাল খেলায় এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টনে তারা প্রাধান্য ধরে রাখছে। বিশেষ করে যখন দুই দেশের খেলাধুলার আলোচনা ওঠে, তখন কারও মনে ‘চিন্ডিয়া’ শব্দটি আসে না। অলিম্পিকের দিকে তাকালে এই দুই দেশের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়বে। রূপকার্থে যদি ধরি তাহলে বলা যায়, একদিকে ভারতে আছে বলিউডের সৃজনশীল এলোমেলো নাচ, অন্যদিকে চীনে আছে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ।

কর্তৃত্ববাদী চীন সরকার এখন কড়াকড়ি সামরিক কায়দায় ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষিত করে অলিম্পিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। আজকের অলিম্পিকে চীনের যে অর্জন তা ভাগ্যক্রমে আসেনি। সুপরিকল্পিতভাবে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর জন্য বিশ্বমানের কোচ নিয়োগ করা হচ্ছে এবং সর্বোচ্চ মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ভারতে ক্রীড়াবিদদের যে প্রশিক্ষণ চলে, তা বিশ্বমানের নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা আনাড়ি পর্যায়ের। এর বাইরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পক্ষপাত ও অপেশাদারি ভারতের খেলাধুলাকে এখনো পেঁচিয়ে ধরে আছে। এই মৌলিক পার্থক্য দুই দেশের সব ক্ষেত্রে দেখা যাবে।

চীন সরকার যদি চায় তারা ছয় লেনের একটা এক্সপ্রেসওয়ে করবে, তাহলে তারা প্রয়োজনে রাস্তার জায়গা বের করার জন্য রাতারাতি কয়েকটি গ্রাম গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ভারতে যদি দুই লেনের একটি রাস্তা চওড়া করার কোনো পদক্ষেপ নেন, তাহলে দেখবেন হয়তো জমির মালিকেরা ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা ঠুকে দিতে পারেন। তা নিয়ে ফয়সালায় আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।

চীনে জাতীয় প্রাধান্য ঠিক করে সরকার এবং তারপর রাষ্ট্র তহবিল সরবরাহ করে। কিন্তু ভারতে কোনো কাজ শুরু করতে গেলে অনন্ত আলোচনা চলতে থাকে এবং তহবিল যেখান থেকে পারা যায়, সেখান থেকে সংগ্রহ করা হয়। টোকিও গেমসে অংশ নেওয়া চীনা অ্যাথলেটদের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, ভারত গত ৭০ বছরেও তাদের অ্যাথলেটদের পেছনে অত অর্থ ব্যয় করেনি।

এ কথা ঠিক যে ভারতে বিশ্বমানের কম্পিউটার বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জৈববিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্রকার আছেন। কিন্তু তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের যে উদ্যোগ, তা চীনের তুলনায় খুবই কম সুশৃঙ্খল। সুদীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চীন বাস্তবায়ন করে কোনো রকম রাজনৈতিক বাধা ছাড়াই। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে বাধা আসে।

যত দিন ভারত এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে না উঠতে পারবে, তত দিনে চীনের সঙ্গে তার সার্বিক মানের দিক থেকে পার্থক্য বাড়তে থাকবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী