চীনের সঙ্গে বিরোধের নীতি হবে আত্মঘাতী

ছবি: রয়টার্স

চীনের প্রতি পাশ্চাত্যের বৈরিতা কোভিড-১৯ সংকট এসে ম্লান করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন যেকোনো মুহূর্তে এটি আবার সামনে চলে আসতে পারে। এ উত্তেজনা বিশ্বকে একটা উভয়সংকটে রেখেছে। চীনের যেহেতু অর্থনৈতিক শক্তি ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর ব্যর্থতা নিশ্চিতভাবেই চলতি সংকট উতরাতে সাহায্য করেনি।

আমি আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি সাধারণত চীন-মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়ন করি প্রধানত একজন ম্যাক্রো ইকোনমিস্ট হিসেবে। কিন্তু চ্যাথাম হাউসের সভাপতি পদে থেকে আমি এ বিষয়ের প্রতি একটা অধিকতর সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি গড়েছি। শুধুই অর্থনৈতিক মাত্রা নয়, একই সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছি নিরাপত্তা, কূটনীতি, সংস্কৃতি এবং অন্যান্য ফ্যাক্টর। আমার মনে হয়েছে, পাশ্চাত্যের যারা চীনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায়, তাদের সামগ্রিকভাবে তার আনুপাতিক ব্যয় এবং তাদের লাভটাও মনে রাখতে হবে।

আমি অনুমান করি যে ইতিমধ্যে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় সরকারগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের চীনা দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন চিন্তারই প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের লাভ বা সুবিধা কিসে। তারা চীনা নীতিতে পরিবর্তন দেখতে আগ্রহী। সেটা অর্জনে তারা কি চীনের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল নেবে? নাকি তার সঙ্গে বল্গাহীন সংঘাতে লিপ্ত হবে। এ ধরনের প্রশ্নের জবাব পেতে হলে খোলা মন থাকতে হবে। চীনা জনগণ সম্প্রতি তাদের আধা বার্ষিক গোল্ডেন হলিডে কাটাল। তাঁরা দেশের ভেতরেই ব্যাপক ভ্রমণ করলেন। কিন্তু সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে তাঁরা পড়লেন না।

পাশ্চাত্য বলছে, চীনা তথ্যে বিশ্বাস নেই। তারা চীনের দাবি নাকচ করে। চীনের কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন তার জনগণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য রাখে। এ যুক্তির অনুকূলে আমি অবশ্য অনেকটাই সহানুভূতিশীল থাকতে চাইব। যদিও চীন এবং কিছু কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র অন্যদের তুলনায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে পারে। কিন্তু একই ধরনের গল্প জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও দেখা যেতে পারে। আর সেটা নির্দেশ করছে যে সাক্ষ্য-প্রমাণকে দ্রুত নাকচ করে দেওয়ার পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়, সেদিকে নজর দেওয়া।

বছরের শেষ ভাগে এসে অনেকের ধারণা, চীন তাদের প্রবৃদ্ধি বছরে ৫ শতাংশ ধরে রাখতে পারবে। এটা ঠিক হলে চীন হয়তো ঠিকই ২০২১ সালে ৮ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এটা হবে চীনের জন্য একটি বিরাট বিজয়। এমনকি, এ পূর্বাভাসও আছে যে আগামী বছরে বিশ্ব জিডিপিতে চীনের অবদান থাকবে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। এর ৪০ ভাগেরই কৃতিত্ব কিন্তু চীনা ভোক্তাদের। একটা তুলনা করি। প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা যদি চলমান থাকে, তাহলে চীন আগামী বছরেই বিশ্ব জিডিপিতে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত জোগান দেবে। এ পরিমাণ হবে ১৫টি শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তির (রাষ্ট্র) সম্মিলিত জিডিপির থেকে বেশি। মাত্র একটি বছরেই চীন অস্ট্রেলিয়া বা স্পেনের মতো দেশের জিডিপির সমান অবদান রাখতে সক্ষম। অবশ্য আমরা অন্যান্য বিষয় উপেক্ষা করতে পারি না।

সুতরাং যদি চীনের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং পশ্চিমাদের জন্য সুবিধাদি সংকুচিত হতে থাকে, এ রকমের অবস্থায় চীনের সঙ্গে একটি বিরোধের নীতি সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া পুরোপুরি আত্মঘাতী হবে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটা সমস্যা

চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড অনেক বড় বিষয়। বিশেষ করে জিনজিয়াং পরিস্থিতি ও হংকংয়ে বিক্ষোভ দমনের কথা বলা যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সমুদ্রে উত্তেজনা বৃদ্ধিকল্পে তার ভূমিকা রাখা এবং সর্বোপরি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অন্যান্য দেশেও তারা প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এমনকি বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও চীনের দলীয় নীতি অনুসরণের চাপ দেওয়ার বিষয়টি পশ্চিমা কোম্পানি এবং সরকারগুলোকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে যারা চীনের সঙ্গে সংঘাতের দিকেই যেতে চায় এবং তারা যদি তাতে সফল হয়, তাহলে তারা মনে রাখবে যে সেটা চীনা প্রবৃদ্ধির গতিকে মন্থর করবে। আর সেটা কিন্তু পাশ্চাত্যের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়িয়ে দেবে না, বরং কমাবে।

সুতরাং যদি চীনের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং পশ্চিমাদের জন্য সুবিধাদি সংকুচিত হতে থাকে, এ রকমের অবস্থায় চীনের সঙ্গে একটি বিরোধের নীতি সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া পুরোপুরি আত্মঘাতী হবে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটা সমস্যা। কিন্তু সব দেশের নাগরিকেরাই অন্য সব বিষয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়টিতেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আগামী মাসে মার্কিন নেতৃত্বে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে জি-২০-তে একটি নতুন গতি প্রত্যাশিত। সরকারগুলোকে একই টেবিলে আনা সম্ভব হবে। একটি অধিকতর সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে সবারই ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী