চে: হৃদয় যাঁর পৃথিবীসমান

চে গুয়েভারা
চে গুয়েভারা

২০০৩ সালে অক্টোবর বিপ্লবের ৮৫তম বার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে মস্কো গিয়েছিলেন চে গুয়েভারার মেয়ে আলেইদা গুয়েভারা। ইজভেস্তিয়া পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, স্বদেশে তিনি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তাঁকে ‘বিশ্বব্যাপী কিউবার রাষ্ট্রদূত’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ জন্য তিনি কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন না। ইজভেস্তিয়ার পক্ষ থেকে আলেইদার প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার বাবাকে এখন রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে বাণিজ্যিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। টি-শার্ট, পোস্টার, কাপে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁর ছবি। এটা আপনি কী চোখে দেখেন?’ উত্তরে আলেইদা বলেছিলেন, ‘কিউবায় চে গুয়েভারার স্মৃতি সংরক্ষণকেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সে প্রতিষ্ঠানই আমার বাবাকে নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এসব বিষয় থেকে অর্থ সংগ্রহের কোনো আগ্রহ আমাদের নেই। আমরা শুধু চাই, চেকে শুধু বাণিজ্যের প্রতীক না করে এমন কিছু করা হোক, যেন তার সামাজিক অর্থ থাকে।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে আলেইদা বলেছিলেন, ‘খুব কম মানুষই চে গুয়েভারার কোমল দিকটি সম্পর্কে জানে। তিনি বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে, সন্তান হিসেবে খুবই কোমল হূদয়ের একজন মানুষ ছিলেন। বেশির ভাগ মানুষই তাঁকে বিপ্লবী, সংগ্রামী বলে জানে, কিন্তু তিনি একজন কোমল হূদয়ের মানুষও ছিলেন। যখন তিনি শেষবারের মতো বলিভিয়ায় যুদ্ধ করতে গেলেন, তখন তাঁর অনুভূতিতে মৃত্যু-আশঙ্কাও ছিল। তাই তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্য, সন্তানদের জন্য এবং মা-বাবার জন্য চিঠি রেখে গিয়েছিলেন। খুবই স্পর্শকাতর ও কোমল সেই চিঠিগুলো।’
বাবার লেখা চিঠিগুলো সম্পর্কে সবিস্তারে জানাতে গিয়ে আলেইদা জানিয়েছিলেন যে বাবা তাঁকে লিখেছিলেন, ‘আমার ছোট্ট আলেইদা! তুমি অবশ্যই বড় হয়ে উঠবে এবং মাকে বাড়ির সব কাজে সাহায্য করবে। তুমি দাদিকে বাড়ির সব কাজে সাহায্য করবে। স্কুলে খারাপ কথা বলবে না...।’ বাবা সম্পর্কে আলেইদার আরও স্মৃতিচারণা: ‘মনে আছে, আমার খুবই ঈর্ষা হয়েছিল আমার ভাই এর্নেস্তোকে লেখা বাবার চিঠিটি দেখে। সেখানে বাবা লিখেছিলেন: “তুই বেড়ে ওঠ। বেড়ে ওঠার পরও যদি যুদ্ধ চলতে থাকে, তাহলে আমি আর তুই একসঙ্গে যুদ্ধ করব। কিন্তু তখন যদি যুদ্ধ থেমে যায়, তাহলে আমি আর তুই মিলে ছুটি কাটাতে যাব চাঁদে।”
বুঝতে পারছেন, বাবা আমাকে রান্নাঘরে বদ্ধ রাখতে চান আর ওকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চান চাঁদে! কী অন্যায় আচরণ! সে সময় এটাই ছিল আমার উপলব্ধি। তাঁর মৃত্যুর পর আমি বাবার সরকারি ক্যাবিনেটটিতে যাই, তখন টেবিলের কাচের নিচে চারটি ছবি আবিষ্কার করি। ছবি চারটির তিনটিতেই ছিলাম আমি। তখন আমি আবার বাবাকে ক্ষমা করে দিই। তিনি আমাকে চাঁদে নিয়ে যেতে চাননি, কিন্তু তিনি আমাকে রেখেছিলেন হূদয়ের গভীরে।’
১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্ম নিয়েছিলেন এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা, পরে যাঁর নাম হয়ে উঠল চে গুয়েভারা। জন্মেছিলেন অভিজাত ও বিত্তশালী পরিবারে। শৈশবেই আক্রান্ত হন শ্বাসকষ্ট রোগে, যা তিনি বহন করেছেন আমৃত্যু। ১৯৪৮ সালে চে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে ভর্তি হন বুয়েনস এইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারুণ্যের ঝলমলে দিনগুলোয় মগ্ন হয়ে পাঠ করেছেন পাবলো নেরুদা, সিগমন্ড ফ্রয়েড আর বার্ট্রান্ড রাসেলদের। তখন থেকেই তাঁর লেখালেখির সূচনা।
১৯৫১ সালের শুরুর দিকে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ও একটি মোটরসাইকেল নিয়ে চে বেরিয়ে পড়েন লাতিন আমেরিকা ঘুরতে। এই ভ্রমণ পাল্টে দেয় তাঁকে। লাতিন আমেরিকাজুড়ে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দুঃশাসন। ভেনেজুয়েলা, পেরু, চিলি ও বলিভিয়া তখন সাম্রাজ্যবাদী শোষণে ধুঁকছে। অমানবিকতার ছবিগুলো চে দেখলেন প্রসারিত চোখে।
বিপ্লব অনিবার্য—এই বোধে পৌঁছাতে চে দীক্ষা নিয়েছিলেন মার্ক্সবাদে। গুয়াতেমালায় গিয়ে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টার পর চলে গিয়েছিলেন মেক্সিকোয়, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেখানেও একই দৃশ্য। লাতিন আমেরিকাজুড়ে চলমান সিআইএর হিংস্র তাণ্ডবলীলা। সবখানেই শ্রেণীবৈষম্য আর শ্রেণীশোষণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন। তীব্র সংবেদনশীল চে বিপ্লবের দাউ দাউ দাহ বুকে অস্থির হয়ে উঠলেন। ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। কাস্ত্রো তখন কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁর গেরিলা দলে যোগ দিলেন চে। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর কিউবার উদ্দেশে যাত্রা করে কাস্ত্রোর গেরিলা দলের যুদ্ধজাহাজ গ্র্যানমা। ১৯৫৭ সালে কাস্ত্রোর গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার নির্বাচিত হলেন। ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে সান্তা ক্লারার যুদ্ধে তাঁর সফল নেতৃত্ব যুদ্ধের নিয়তি নির্ধারণ করে দিল। কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তা সদলবলে পালালেন কিউবা ছেড়ে। বিপ্লব হলো কিউবায়।
সফল বিপ্লবী চের বুকে এখন অন্য দেশগুলোতে বিপ্লবের স্বপ্ন। কিউবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শেষে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন ১৯৬৫ সালে। কঙ্গোতে কয়েক মাস থেকে ফিরলেন কিউবায়, তারপর আবার যাত্রা, ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে পৌঁছে গেলেন বলিভিয়ায়। যে বলিভিয়ার সামরিক শাসক বারিয়েন্তোসের বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিপ্লব করতে চাইলেন, সেই বলিভিয়ার কৃষক ও সাধারণ মানুষ তাঁকে ভেবেছিল আগন্তুক মাত্র। অসহযোগিতা ছিল বলিভিয়ান কমিউনিস্ট পার্টিরও। একটি বিচ্ছিন্ন গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হলেন চে। আহত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রশিক্ষিত বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দী হলেন তিনি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর।
১৯৮৭ সালের ৮ অক্টোবর চের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেওয়া বক্তৃতায় ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘...বছরে কেবল একবার চের প্রতি সম্মান জানানো হয়, এমন নয়। কিংবা ৫, ১০, ১৫ বা ২০ বছরে একবার তাঁকে সম্মান জানানো হয়—তেমনও নয়। তাঁর প্রতি সম্মান জানানো হয় প্রতিবছর, প্রতি মাসে, প্রতিদিন, প্রতিটি কারখানায়, বিদ্যালয়ে, সামরিক ব্যারাকে, বাড়িতে। সম্মান জানায় শিশুরা, অগ্রপথিকেরা। “কমিউনিজমের অগ্রপথিক, আমরা সবাই চে হব”—এই স্লোগান ২০ বছরে কত হাজার-লাখোবার যে দেওয়া হয়েছে, তার হিসাব নেই।’
চে গুয়েভারা যে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন, তা আজও দুঃশাসনের অন্ধকারে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলছে। তিনি বলতেন, ‘আসতা লা ভিকতোরিয়া সিয়েম্প্রে’। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। তিনি আরও বলেছেন, ‘পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যায়কে সব অবস্থায়, সব সময় গভীরভাবে অনুভব করার সামর্থ্য অর্জন করো। এটাই একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে সুন্দর গুণ।’
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]