ছাপা পত্রিকা হাতে নেওয়া মানে দেশে আছি

করোনা সমাজ নামক সম্পর্কটাকে তো চুপসে দিয়েছে, ছাপা পত্রিকারও কি সেটাই পরিণতি! এ ব্যাপারে দুই ধরনের কথাই আছে। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশেই করোনার সময়ে অনেক পাঠক ছাপা দৈনিক পত্রিকার গ্রাহক হয়ে গেছেন। ঘরবন্দী জীবনে তাঁদের কাছে সেটাই বাস্তবের স্পর্শ। মঙ্গল গ্রহ থেকেও অনলাইনে পত্রিকা পড়া যায়, কিন্তু ছাপা পত্রিকা হাতে নেওয়া মানে দেশে আছি, দেশি মানুষের মধ্যে আছি। উল্টো দিকে করোনার সময়ে অনেকেই ছাপা পত্রিকা ছেড়ে অনলাইনে খবর পড়ায় মজে গেছেন। চাইলাম, কোনো পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকলাম, কিছু পড়লাম বা দেখলাম—বেরিয়ে এলাম। এটা এমন এক রাস্তা, যেখানে চলাচলে মাটিতে পা পড়ে না, কোনো স্পর্শ লাগে না। বিনা পানিতে গোসল সারার মতো অভিজ্ঞতা।

ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আর ভবিষ্যতের ব্যাপার না, তা ঘটমান বর্তমান। অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অনেকে শুধু অনলাইনে মুখ গুঁজে বাঁচতে চাইছে। এই অর্থনৈতিক হাহুতাশার পাশাপাশি ছাপা পত্রিকার জন্য দুঃখ করার আরও কারণ আছে।
ছাপা সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। পত্রিকার মাধ্যমে বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল জনগণ সচেতনভাবে নিজেদের নেতা নির্বাচন করতে পারে, সরকারের কর্মকাণ্ডে চোখ রেখে দরকারমতো সমালোচনা বা সমর্থন করতে পারে। স্বাধীন ছাপা পত্রিকা যেন গণতন্ত্রের আরেকটা প্রতিনিধি সভা, আরেকটা পার্লামেন্ট—যেখানে দেশের জাতীয় অবস্থা উঠে আসে, উঠে আসে সমস্যার বিবরণ আর সমাধান নিয়ে আলোচনা।

একটি দেশের সংবাদপত্র হলো সেই দেশের প্রতিদিনকার জাতীয় জীবনী। জাতির জীবনীর একেকটি পৃষ্ঠা হলো একেক দিনের সংবাদপত্রের ছাপা পাতাগুলো। যখন অনলাইন-ইন্টারনেট ছিল না, তখন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করার প্রধান দুটি হাতিয়ারের একটি ছিল সংবাদপত্র, অন্যটি রেললাইন। লেনিন সংবাদপত্রকে বলতেন যৌথ সংগঠক। বাস্তবে কারও পক্ষেই দেশের সব মানুষের সম্পর্কে জানা বা সব এলাকার খোঁজ রাখা অসম্ভব। সংবাদপত্র যখন সারা দেশের খবর দেয়, তখন অজানা মানুষ, অজানা এলাকা এবং অভিজ্ঞতার বাইরের জীবনের সঙ্গে জানাজানি ঘটে। এভাবে দিনে দিনে সংবাদপত্র তার পাঠকের মনে দেশ, দেশের জীবনযাত্রা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলে।

সমাজবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের বিখ্যাত একটি বই হলো ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটিজ’। এই বইয়ে তিনি জাতি, জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রের বিকাশে সংবাদপত্র ও ছাপাখানাকে ধাত্রীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার বিচ্ছিন্ন মানুষদের মনে একক দেশের কল্পনা জাগানোর এই কৃতিত্ব তিনি সংবাদপত্রকে দিয়েছেন। সত্যিই তো, সংবাদপত্র ছাড়া আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম বেগবান হতে পারত কি? যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জাতীয় অবস্থার চলতি চালচিত্র সম্পর্কে না জানা যেত, তাহলে দেশের অধিকাংশ মানুষ একই আনন্দ-বেদনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়ে পথে নামত কি? ব্রিটিশ ও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সফলতার একটা চালিকাশক্তি হলো সে সময়ের জনপ্রিয় সংবাদপত্র।

সংবাদপত্রের বিরাট শিরোনাম আর বড় ছবি পাঠককে জানায়, আজকের প্রধান ঘটনা কী। মানুষের মনোযোগকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসার এই ক্ষমতা অনলাইন মাধ্যমের ততটা থাকার কথা নয়। কারণ, তা স্থায়ী নয়। অনলাইনে কোনো খবরই বেশিক্ষণ সামনে থাকে না, কেবলই শিরোনাম বদলে যায়, কেবলই দৃশ্য বদলে যায়। নিরন্তর এই বদলের মধ্যে দিনের প্রধান বিষয়বস্তু যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি পাঠক হিসেবে আমি যা খুঁজছি, তা পিছলে পেছনে চলে যায়। এক অন্তহীন স্ক্রলিংয়ের মধ্যে পাঠক সেখানে আর পাঠক থাকেন না, হয়ে যান দর্শক। খবর তিনি দেখেন, আবছা করে পড়েন। একটা লেখা পড়তে পড়তে চোখ চলে যায় আরেকটা খবরের লিংকে অথবা ফেসবুক পোস্টে—মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অনলাইন স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ক্লান্তি বোধ হয়, চোখ হয়রান হয়ে পড়ে।

এই অসুবিধা ছাপা পত্রিকায় কম। কারণ, যত ভালো পত্রিকা, তত গোছানো তার সংগঠন, অর্থাৎ পৃষ্ঠাবিভাজন। যত গোছানো সংবাদপত্রের একেকটি বিভাগ, পাঠক তত সাবলীলভাবে পছন্দের পৃষ্ঠায় পৌঁছে যান। সংবাদপত্র পারিবারিকও। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভাগের ব্যাপারটা পরিবারের একাধিক পাঠকের জন্য আরামদায়কও। হয়তো পিতা নিলেন রাজনৈতিক খবরপ্রধান প্রথম পৃষ্ঠা, মা নিলেন পছন্দের ফিচারের বিভাগ, ভাইবোনেরা কেউ আন্তর্জাতিক পাতা, কেউ খেলার পাতা টেনে নিয়ে একসঙ্গে পড়তে শুরু করে।

দৃশ্যটা কল্পনা করুন। ভোরে, বাড়িতে পত্রিকা আসামাত্রই বাবা বসলেন কাগজ নিয়ে, পাশে রাখা ধূমায়িত চা বা কফি। তাঁকে ঘিরে পরিবারের বাকি সদস্যরা একেকজন একেক পৃষ্ঠা নিয়ে টানাটানি-খুনসুটি করছে, যে যার পছন্দের পাতা খুলে উবু হয়ে মেঝেতে বা চেয়ারে বসে পড়ছে। তাকালেই মনে হবে একটা দারুণ পরিবার, একটা দারুণ পাঠকের সমবায়। এ ধরনের পরিবারে শিশু-কিশোরের পড়ুয়া ও বিচক্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিপরীতে, অনলাইন পত্রিকা ব্যক্তিগত, যার যার স্ক্রিনে একা একা স্ক্রল করে যাওয়ার নিঃসঙ্গতা।

সংবাদপত্র মধ্যবিত্তেরই ছিল বেশি। বাড়িতে একটি-দুটি পত্রিকা রাখা সংস্কৃতিরও বিষয়, শ্রেণি উত্তরণেরও বিষয়। দেশে গ্রাম-মফস্বল থেকে উঠে আসছে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যদি আয় অনুমোদন করে, তাহলে তাদের তো বাড়িতে পত্রিকা রাখার সংস্কৃতি চর্চা করার কথা। ছাপা পত্রিকা এই উঠতি মধ্যবিত্তের মনে জায়গা করতে পারলে এই অকালে নতুন আর্থিক ভিত্তি খুঁজে নিতে পারে।

আমরা বড় হয়েছি অ্যানালগ যুগে, সংবাদপত্রের সঙ্গে। বাড়িতে একসময় সাপ্তাহিক একতা আর সংবাদ আসত। শুধু খবর না, অজানা দেশের রোমাঞ্চকর গল্প, প্রিয় কোনো ব্যক্তিত্বের ছবি, কোনো কৌতূহলজনক জ্ঞান, সাহিত্য পাতার কোনো ধারাবাহিক—প্রতিদিনের পত্রিকা পড়ার পর মনে হতো ‘দুনিয়া সম্পর্কে আরেকটু বেশি জানলাম’। পাঠকের হয়ে দরকারি এই বাছাই কর্মটা সম্পাদকই করে দেন। আজকের মতো ডিজিটাল সুনামির মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে চাওয়ার জিনিসটা খোঁজার পেরেশানি তখন ছিল না।

যখন আজকের কাগজ এবং তারপরে ভোরের কাগজ আসা শুরু হলো, তখন ভালো লাগল এদের সাজসজ্জা। তত দিন কিছুটা বড় হয়েছি, আন্তর্জাতিক খবরের পাশাপাশি মতামত পাতার কলামগুলোয় চোখ বুলাচ্ছি। একটু একটু শিখছি মতামত লেখকদের যুক্তি দেওয়ার কৌশল, গল্প বলার মুনশিয়ানা, তর্ক করার ধার। হ্যাঁ, লেখালেখিটা ছাপার হরফ থেকেই শেখা—সম্ভবত সেটাই সবচেয়ে টেকসই ও ভরাট শিক্ষা। সেই শিক্ষার মধ্যে ডিজিটাল গুজবের রমরমা ছিল না, ছিল ছাপা পত্রিকার বিশ্বাস্য উপস্থাপনা। অনলাইনে ভুল করলে মুছে দেওয়া যায়, ছাপা পত্রিকার ভুল সহজে মোছে না।

সকালে আরাম করে পত্রিকা পড়া মানে দিনটা ভালোভাবে শুরু হলো। নতুন প্রজন্ম হয়তো অন্যভাবে ভাববে। হয়তো অনলাইন স্ক্রিনে মিনিটে মিনিটে বদলে যাওয়া কনটেন্ট তার মুডও মিনিটে মিনিটে বদলে দেয়। এক নদীতে যেমন দুবার সাঁতার দেওয়া যায় না, অনলাইনে হাজির হওয়া খবর বা লেখা কখনোই আগের মতো থাকে না। কিন্তু সংবাদপত্র হলো সময়ের চলতি জাদুঘর, যাতে আপনি থেমে থেমে ঘুরে ঘুরে (পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে) দেখতে পারেন, যেকোনো সময় আবার ফিরে যেতে পারেন প্রথম পৃষ্ঠায়। ছাপা সংবাদপত্র বিশ্বস্ত, এর পেছনে আপনাকে দৌড়াতে হয় না। এটা আপনার জন্য অপেক্ষা করে।

ছাপা পত্রিকা যদি হয় নোঙর, অনলাইন হলো পাল। জীবনের যাত্রাপথে দুটোকেই যার যার জায়গায় দরকার।

ফারুক ওয়াসিফ: কবি ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]