ছোট মন নিয়ে গণতন্ত্র চর্চা করা যায় না

যে আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ
যে আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ

সবাই প্রশ্ন করছেন—কী হবে, কী ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে? দর্শক-পাঠকেরা সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্নটা করেন, আর সাংবাদিকেরা করেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। একটু আগে একজন টিভি সাংবাদিকও আমাকে এই একই প্রশ্ন করছিলেন। আমি একজন গোবেচারা সমাজবিজ্ঞানী। আমার বিদ্যা আমাকে সমাজের মূল প্রবণতাসমূহ বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছে। কিন্তু এখন কী হবে, সেটা বিশ্লেষণ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। অনেকে প্রশ্ন করেন, আবার এক-এগারো হবে কি না। অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি না। ইতিহাসে কখনো কখনো পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে বেশির ভাগ সময়ই ঘটে না। আর ঘটলেও ভিন্ন অবয়বে ঘটে। তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর কাদের কাছে খুঁজব? পেশাগতভাবে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলেন জ্যোতিষীরা। আমি ঠাট্টা করছি না। ভারত উপমহাদেশেই জ্যোতিষীরা একটি চাঞ্চল্যকর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা সম্পূর্ণভাবে ফলে গিয়েছিল। ঘটনাটা বর্ণনা করা হয়েছে ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়েরের ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট গ্রন্থে। ঘটনাটা হচ্ছে এ রকম:
১৯৪৭ সালে ভারতকে যখন স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তখন কংগ্রেস নেতাদের বলা হয় যে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা আগে ঘোষণা করা হবে। এরপর ১৪ আগস্ট রাতে অথবা ১৫ আগস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন করাচি গিয়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কংগ্রেসের নেতারা ছিলেন খুবই হুঁশিয়ার। তাঁরা এই খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি জ্যোতিষীর কাছে গেলেন। জ্যোতিষীরা লগ্ন হিসাব কষে বললেন, ১৪ আগস্ট মধ্যরাতের আগে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষিত হলে মহাবিপদ ঘটবে। ভারতের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কংগ্রেসের নেতারা জওহরলাল নেহরুর কাছে দৌড়ালেন। নেহরু তুকতাক মানেন না। তবু তাঁকে বাধ্য করা হলো মাউন্টব্যাটেনকে অনুরোধ করতে, যাতে ভারতের স্বাধীনতা ১৪ আগস্ট মধ্যরাতের পরে ঘোষিত হয়। এর পর মাউন্টব্যাটেনের দপ্তর থেকে জিন্নাহকে আগে স্বাধীনতার সনদ গ্রহণে অনুরোধ করা হয়। জিন্নাহ মহানন্দে রাজি হন। ফলে ১৪ আগস্টের দিনের বেলা পাকিস্তান স্বাধীন হয়। আর রাত ১২টার পরে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তী ইতিহাস থেকে জ্যোতিষীরা অভ্রান্ত প্রমাণিত হন।
১৪ আগস্ট রাত ১২টার আগে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্র জন্ম নেয় তা ভেঙে যায়, আরও কত ভাঙবে তা জানি না। অথচ রাত ১২টার পর জন্ম নেওয়া ভারত তার অস্তিত্ব এখনো অটুট রেখেছে। আমি তাই গণমাধ্যমের বন্ধুদের অনুরোধ করব, তাঁরা যেন শুধু বিজ্ঞজনদের কাছে দৌড়াদৌড়ি না করে জ্যোতিষীরা এ সম্পর্কে কী বলছেন, তা যেন আমাদের অবহিত করেন। যদি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস না করেন, তাহলে ঐতিহাসিকদের কাছে যেতে পারেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে অভিনব নয়। ঐতিহাসিকেরা আপনাদের নিয়ে যাবেন অষ্টম শতাব্দীতে। এই শতাব্দীর প্রায় প্রথম ৫০ বছর ধরে বাংলায় মাৎস্যন্যায় বিরাজ করেছিল। মাৎস্যন্যায়ের সরল অর্থ হলো মাছের মতো অবস্থা। অর্থাৎ বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। সমাজে যখন নৈরাজ্য থাকে, তখন যাঁরা সমাজে শক্তিশালী, তাঁরা দুর্বল মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়ন করে থাকেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের আদিকালে যে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল, তার সমাধান অস্ত্রের বলে করা সম্ভব হয়নি। এর সমাধান হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমে গোপালকে রাজা নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নৈরাজ্যের অবসান করা হয়েছিল।
আমার মনে হয়, আমাদের আজকের সমস্যা সমাধানে যদি গণভোটের ব্যবস্থা করা হতো, সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে টেকসই ও মঙ্গলজনক হতো। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে কখনোই এখানে অগণতান্ত্রিক শক্তি দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারেনি। এমনকি ১৯৭১ সালে আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেটাও ছিল একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই এখানে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, তা কখনোই টেকসই হবে না। আবার ইতিহাস এই সাক্ষ্যও দেয়, মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো কাউকে বসানো হলে তার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ বারবার বিদ্রোহ করেছে।
যদি জ্যোতিষী ও ঐতিহাসিকদের পছন্দ না হয়, তাহলে আপনাকে যেতে হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে। তাঁরা আমাদের বলবেন, এই সংকট সাময়িক সংকট নয়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার গভীরে এই সংকটের মূল নিহিত। আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে বারবার এ সংকটের কারণ হলো, এখানে যে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে, সেটা অনেকাংশেই একটি খোলস। এর ভেতরে কোনো প্রাণশক্তি নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উদারনৈতিক মূল্যবোধের দরকার। ছোট মন নিয়ে গণতন্ত্রের মতো মহৎ আদর্শের বাস্তবায়ন করা যায় না।
কিন্তু সমস্যাটা আরও জটিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি কারণে এখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা দখল করলে কেউ ছাড়তে চায় না। প্রথম কারণ হলো, এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের শীর্ষবিন্দুতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষেধক ও নিবারক নেই। এর ফলে সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্যও (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) নেই। দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো, বাংলাদেশে খারাপ কাজ করলে কোনো বিচার হয় না, আর ভালো কাজ করলেও পুরস্কার থাকে না। কাজেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে অভূতপূর্ব সব কর্মকাণ্ড অবলীলায় করা সম্ভব হয়।
তৃতীয়ত, যে নির্বাচনব্যবস্থা, তাতে কোনোমতে এক ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হলেই পাঁচ বছরের জন্য সাংসদ নির্বাচিত হওয়া সম্ভব। এর ফলে নির্বাচনে জাল-জালিয়াতির আকর্ষণ অনেক বেশি। এ ধরনের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও জালিয়াতি ঘটে। পৃথিবীর অনেক দেশেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের বড় দুই জোটই এ সম্পর্কে কোনো কথা বলছে না বা কেউ বললেও গুরুত্ব দেয় না। সবশেষে, এখানে সরকার ও দলের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলা হয়েছে। যিনিই সরকারপ্রধান, তিনিই দলের প্রধান। তাই দলের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না। দল ও সরকার একাকার। বড় দুই রাজনৈতিক জোটের কেউই দীর্ঘস্থায়ী ও মৌলিক পরিবর্তন সম্পর্কে কখনোই কোনো কথা বলেন না। দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন না করার মতো ব্যাপারে দুটি দলই একেবারে একমত। সুতরাং মৌলিক ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। ভিন্নমত শুধু স্বল্পস্থায়ী নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে। কাজেই আমাদের একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে।
যদি জ্যোতিষী, ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানী—তাঁদের কাউকেই আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে আপনাকে যেতে হবে ক্রীড়াতত্ত্ববিদ বা গেম হিরোইস্টদের কাছে। তাঁরা বলবেন, এটি একটি হার-জিতের (জিরো-সাম গেম) খেলা। এই খেলায় কী ধরনের রণকৌশল অবলম্বন করলে জেতা যায়, সেটা তাঁরা বাতলে দিতে পারবেন। আমার অবশ্য এ খেলায় আগ্রহ নেই। কারণ, এ খেলা খেলতে গেলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে যে দুর্যোগটা নেমে আসবে, তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশে আজ যে সমস্যা, তা রাজনীতিকেরা সৃষ্টি করেছেন। নাগরিক হিসেবে আমাদের দাবি যে তাঁদের তৈরি সমস্যার সমাধান তাঁদেরই বের করতে হবে।
আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।