ছয় দফায় ভয় পাকিস্তানিদের

একাত্তরে উত্তাল ছিল বাংলাদেশ। একদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা, অন্যদিকে পাকিস্তানিদের অভিযানের প্রস্তুতি। পাকিস্তানি আমলা হাসান জহির খুব কাছ থেকে ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছেন। জানুয়ারি–মার্চের ঘটনাবলির ভেতর–বাহির উঠে এসেছে তাঁর বই দ্য স্যাপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দ্য রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম–এ। হাসান জহির পূর্ববঙ্গে এসডিও হয়ে আসেন ১৯৫৬ সালে। ১৯৭১ সালে হাসান জহির নিজেকে আবিষ্কার করেন ভিন্নভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ভিন্ন জগতে চলে এলাম, যেখানে বাঙালিরা আমাকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অংশ হিসেবে মনে করে। আমাকে তাদের জন্য তাদের একজন ভাবে না।’ তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব আজ।

দ্য স্যাপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান বইয়ের প্রচ্ছদ

১৯৭০ সালের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে শঙ্কা ছিল। তবে তারা ভাবতে পারেনি আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভয় ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এম এ জি ওসমানী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হবেন এবং তিনি কর্মজীবনে তাঁর বঞ্চনার প্রতিশোধ নেবেন।

৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুজিবের ভাষণ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে আরও বিচলিত করে। তাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নমনীয় হবে। কিন্তু শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুজিব ঘোষণা করলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে কেউ বাধা দিতে পারবে না। ছয় দফার প্রতি জনগণ যে রায় দিয়েছে, তা পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল করিমের ভাষ্য অনুযায়ী, মুজিবের এ বক্তৃতা ইয়াহিয়া খানকে হতাশ করে এবং তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করতে বলেন।

করিম তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, নির্বাচনী প্রচারকালে মুজিব সব সময় এ কথা বলে আসছেন। তখন আপনি কিছু বলেননি।

হাসান জহিরের পর্যবেক্ষণ: নির্বাচনী ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার করে। এটিকে তারা একটি দলের নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় হিসেবে নিয়েছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা ভাসানী, যিনি সত্তরের নির্বাচন বর্জন করেছিলেন, ঘোষণা দেন নির্বাচনের বিজয় পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার বিজয় এবং আওয়ামী লীগ যদি এ অবস্থান থেকে সরে যায়, তাহলে গণ-আন্দোলন শুরু করা হবে।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দেশের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ভুট্টো ‘টেকসই ও গ্রহণযোগ্য’ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ও সব ইউনিটের সম্মতিতে সংবিধান রচনার ওপর জোর দেন। পিপলস পার্টির সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রে কোনো সরকার গঠিত হতে পারবে না বলেও হুমকি দেন। মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দেন, তাঁর দল এককভাবে কেন্দ্র ও বাংলাদেশে সরকার গঠন করতে সক্ষম।

অনড় শেখ মুজিব

এ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু মুজিব তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে দুটি মত চালু আছে। প্রথমত, মুজিবের আশঙ্কা, পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের এটা বোঝাতে চান, ঢাকাই হবে ক্ষমতার কেন্দ্র। হাসান জহির লিখেছেন, তাঁর মনে দুই চিন্তাই কাজ করে থাকতে পারে। ইয়াহিয়া খান জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকা আসেন। মুজিবের সঙ্গে তাঁর দুই দফা বৈঠক হয়। দুজনের মধ্যে প্রথম বৈঠক হয় কোনো সহযোগী ছাড়াই। দ্বিতীয় বৈঠকে সহযোগীরা যোগ দেন। জেনারেল করিম সেই বৈঠকের ভাষ্য তুলে ধরেছেন এভাবে:

ইয়াহিয়া: রেসকোর্স ময়দানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আপনি এটা কী করলেন?

মুজিব: এটি আমার দর-কষাকষির দফা। আমি পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছি। আমি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা নির্দিষ্টভাবে অর্থনৈতিক অধিকার এবং সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে দাবি পেশ করতে যাচ্ছি।

ইয়াহিয়া: আমি সে জন্য কাজ করছি। এ কারণেই আমি এক মাথা এক ভোট দিয়েছি। আমি কী চাই, তা আমি আমার বহু বিবৃতিতে বলেছি। সে ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই।

মুজিব: কিন্তু আপনি বলেছেন সংবিধানে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একমত নন।

ইয়াহিয়া: না, আমার জেনারেলরা কাজ করছেন কোনো একটা পথ বের করতে।

মুজিব: আমি ঘোষণার আগে আপনাকে দেখাব। আপনার বলার কিছু থাকলে তখন বলতে পারবেন।

ইয়াহিয়া খানের বাঙালি উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, ইয়াহিয়া এ বৈঠকের ফলাফলে হতাশ ছিলেন। তাঁরা একে অপরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মুজিবকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এবং ইয়াহিয়া খানকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।

তাঁদের পরবর্তী কথোপকথন ছিল মোটামুটি এ রকম:

ইয়াহিয়া: দুঃখজনক যে আপনি এমন একটি দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, যে দল পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। সেখানে ভুট্টো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন এবং ফলাফল আমাকে জানান।

মুজিব: স্যার, এটা হলো গণতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমিই সরকার গঠন করব।

ইয়াহিয়া: আপনাকে সুস্বাগত। কিন্তু আপনাকে অবশ্যই গোটা পাকিস্তানের কথা ভাবতে হবে।

মুজিব: হ্যাঁ, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আসছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলছেন।

ইয়াহিয়া: মি. ভুট্টো আসেননি।

মুজিব: মি. ভুট্টো আসেননি। কিন্তু অন্যান্য নেতা এসেছেন, কথা বলেছেন।

ইয়াহিয়া: বন্ধু, কারা অন্যান্য নেতা, যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজিত দলের নেতা? একত্রে থাকার জন্য সব ফেডারেল ইউনিটের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন।

মুজিব: যে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আসতে পারেন।

ইয়াহিয়া: আপনি বৃহত্তম দলের নেতা। আপনি তাঁদের কাছে যান এবং কথা বলুন।

সহযোগীদের নিয়ে তাঁদের দ্বিতীয় বৈঠক হয় পরদিন। এতে মুজিবের সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এম মনসুর আলী। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ছিলেন পীরজাদা ও গভর্নর আহসান। আহসানের ভাষ্যমতে, এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতারা ছয় দফা উপস্থাপন করার পর দুই পক্ষের মধ্যে নিম্নোক্ত কথোপকথন হয়।

মুজিব: আপনি এখন জানলেন ছয় দফা কর্মসূচি কী? আপনি বলুন, এ কর্মসূচির কোথায় আপনার আপত্তি আছে?

ইয়াহিয়া: শেখ সাহেব, ছয় দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আপনাকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে নিতে হবে।

মুজিব: অবশ্যই। অনুগ্রহ করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকুন। আমার পরামর্শ ১৫ ফেব্রুয়ারি। আপনি দেখবেন, আমি কেবল সাধারণ নয়, দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাব।

আহসান: আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের দিকে না তাকিয়েও সংবিধান চাপিয়ে দিতে পারে।

মুজিব: না, না, আমি একজন গণতন্ত্রী এবং গোটা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আমি পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারি না। আমি কেবল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নই, বিশ্বজনমতের কাছে দায়বদ্ধ। গণতান্ত্রিক নীতিমালার জন্য আমি সবকিছুই করব। অধিবেশন শুরুর তিন বা চার দিন আগে আপনি ঢাকায় আসুন, আমি আপনাকে খসড়া সংবিধান দেখাব। আপনি যদি কোনো বিষয়ে আপত্তি করেন, আমি আপনার ইচ্ছাকে বিবেচনায় নেওয়ার চেষ্টা করব। আমরা অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের ভাষণের খসড়াও তৈরি করব। এরপর আমরা গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের সব বিধি অনুসরণ করব। আমাদের একটি সাবজেক্ট কমিটি থাকবে, সেখানে আমরা ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করব এবং অধিবেশনের ভেতর ও বাইরে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করব।

আগামীকাল: বাঙালির দুই সুহৃদ আহসান-ইয়াকুব

l সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]