জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ভোট না দেওয়ার যুক্তি কী?

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ যে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার সহিংসতা ও প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে এবং দেশটিতে সমরাস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে গত শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবটির বিপক্ষে আমরা ভোট দিইনি। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবটির বিপক্ষে একমাত্র ভোটটি দিয়েছে বেলারুশ। বাংলাদেশ যেহেতু প্রস্তাবটির পক্ষেও ভোট দেয়নি, সেহেতু বেলারুশের সঙ্গী হওয়াও অসম্ভব ছিল না। বেলারুশের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা গড়ার উদ্যোগের পটভূমিতে এ রকম হতেই পারে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছে ১১৯টি দেশ। এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে মিয়ানমারের চলমান সংকটের বিষয়ে কোনো প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে।

নিউইয়র্ক টাইমস ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, শুক্রবারের ভোটটি শীতলযুদ্ধ অবসানের পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চতুর্থ ভোট, যাতে কোনো দেশে সামরিক শাসনের নিন্দা জানানো হলো। আরও বিরল হচ্ছে কোনো দেশে সমরাস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান। আমরা যেমন অস্ত্র রপ্তানি বন্ধের পক্ষে দাঁড়াইনি, তেমনই সামরিক শাসনের নিন্দাও জানাইনি।

বাংলাদেশের জন্য যে প্রস্তাব ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’, সেই প্রস্তাবে কোনো ভোট না দিলে কীভাবে তার গুরুত্ব প্রমাণিত হয়—এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ কেন সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে দাঁড়াতে পারেনি, তার একটা ব্যাখ্যাও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমার বক্তৃতায় রয়েছে। তাঁর কথায় মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর আজকের প্রস্তাবটি ‘বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে; আমরা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। সে কারণে নৃশংস অপরাধের শিকার যে রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাদের সমস্যার একটা টেকসই সমাধানের জন্য মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রস্তাবটিতে আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে, বিশেষভাবে রোহিঙ্গাসহ বাস্তুচ্যুত সংখ্যালঘুদের নিরাপদে, স্বেচ্ছামূলক এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জরুরি প্রয়োজনীয়তা এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হয়নি।’

বাংলাদেশের জন্য যে প্রস্তাব ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’, সেই প্রস্তাবে কোনো ভোট না দিলে কীভাবে তার গুরুত্ব প্রমাণিত হয়—এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। রোহিঙ্গাদের প্রতি নৃশংসতার জন্য জাতিসংঘের তদন্তকারীরা যেখানে দেশটির সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন এবং আন্তর্জাতিক আদালত, আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশে যেখানে সেনাবাহিনীকে গণহত্যার মতো অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করার কথা বলা হয়েছে, তখন ‘মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখাকে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের সূত্র বিবেচনা করা কি কোনো গৌণ বিভ্রান্তি? নাকি সেখানকার সামরিক জান্তাকে তুষ্ট করার সমতুল্য বিপজ্জনক পদক্ষেপ? আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশটির বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এককভাবে দায়ী করছে?

মোটামুটিভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচনকে বাতিল করে দিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করার পর সেখানে যে গণপ্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তার স্বতঃর্স্ফূততা ও ব্যাপকতা প্রশ্নাতীত। ওই নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি পাল্টা সরকারও গঠন করেছে এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়ের আইনগত স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। ওই বেসামরিক সরকার রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা করার কথাও বলেছে।

সামরিক জান্তার নির্বিচার দমননীতির কারণে গত পাঁচ মাসে হাজারখানেক বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং হাজার হাজার নাগরিক আহত হয়েছেন, জেলে আটক আছেন কয়েক হাজার রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনকারী, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষ। সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের মুখে প্রতিরোধের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণের পথেও কেউ কেউ পা বাড়িয়েছেন।

সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি না হলেও সেই প্রস্তাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐকমত্যের ব্যাপকতা ও নৈতিক শক্তির প্রতিফলন ঘটে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। সুতরাং, সাধারণ পরিষদে ঐকমত্য তৈরিতে এবং তাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গুরুত্ব কেউই অস্বীকার করতে পারে না।

এ পরিস্থিতিতে দেশটিতে একটি ব্যাপক আকারের গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী অনেক দিন ধরেই দেশটিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ ও লড়াই চালিয়ে আসছিল। সেসব গোষ্ঠীর কোনো কোনোটি কয়েক বছরের যুদ্ধবিরতি ভেঙে এখন বেসামরিক সরকারের পক্ষে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ পটভূমিতেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে আরেকটি বেসামরিক গণহত্যা ঠেকানো ও সামরিক জান্তাকে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে বাধ্য করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রশ্ন এসেছে। নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার আপত্তির কারণে জাতিসংঘ ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় থেকে আজ অবধি কোনো কার্যকর প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার দায় প্রধানত নিরাপত্তা পরিষদের এই বিভক্তির।

বিপরীতে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবগুলোর গুরুত্ব হচ্ছে এর নৈতিক মূল্য। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি না হলেও সেই প্রস্তাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐকমত্যের ব্যাপকতা ও নৈতিক শক্তির প্রতিফলন ঘটে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। সুতরাং, সাধারণ পরিষদে ঐকমত্য তৈরিতে এবং তাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গুরুত্ব কেউই অস্বীকার করতে পারে না। লক্ষণীয় হচ্ছে, চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীসহ যেসব দেশ অতীতে সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে, এবার তারা সবাই ভোটদানে বিরত থেকেছে। বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকা তাই ওই দেশগুলোর অবস্থানের সমতুল্য হিসেবে গণ্য হলে তা নাকচ করা সহজ নয়। তবে এ কথাও বলা দরকার যে মিয়ানমারে সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হলেও চীন, রাশিয়া ও ভারত প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তাদের এই কূটনৈতিক কৌশলের ব্যাখ্যা অচিরেই মিলবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের কূটনীতিকরা কোন বিবেচনায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দেশটির সামরিক জান্তার প্রতি এমন সদয় হতে পারেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে রোহিঙ্গাদের মতামতকেও যদি তাঁরা বিবেচনায় নিতেন, তাহলেও এমনটি হওয়ার কথা নয়।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ এর আগেও দেখেছি। গত ২৭ মার্চ নেপিডোতে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশের অংশগ্রহণ নিয়ে তখন একই ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল। মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে ওই দিনই সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঘটেছিল; আর সেদিন অধিকাংশ দেশ সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ বর্জন করলেও চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়েছি। ওই ঘটনায় শুধু মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরাই যে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্রপন্থীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

আমাদের কূটনীতিকরা কোন বিবেচনায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দেশটির সামরিক জান্তার প্রতি এমন সদয় হতে পারেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে রোহিঙ্গাদের মতামতকেও যদি তাঁরা বিবেচনায় নিতেন, তাহলেও এমনটি হওয়ার কথা নয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় যদি কোনো প্রতিবন্ধকতাও থেকে থাকে, তা হলেও বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিলেই তাঁরা দেখতে পেতেন যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো থেকে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁরা বেসামরিক রাজনীতিকদের বিপরীতে সামরিক জান্তারে ওপর কোনোভাবেই আস্থা বা বিশ্বাস রাখেন না।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক