জ্যাক মার ওপর কেন চড়াও আংকেল সি?

জ্যাক মা
ছবি: সংগৃহীত

চীনের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটি পুঁজিতান্ত্রিক, না সমাজতান্ত্রিক—এ নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এটা। তবে এতে অনেকগুলো অপ্রচলিত বৈশিষ্ট্য আছে। সেই বৈশিষ্ট্যের মুকুটে সি চিন পিং নতুন এক পালক যুক্ত করলেন সম্প্রতি, যা আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্রের মুরুব্বিদের বেশ চমকে দিয়েছে। কিন্তু সততার ঘাটতির কারণে আংকেল সিকে অভিনন্দন না জানিয়ে নিন্দাই করে চলেছে তারা। পাশাপাশি ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ দিকটাও গোপন করছে।
আলিবাবা ও জ্যাক মা বাংলাদেশেও পরিচিত। গত এক দশকে কয়েক হাজার কোটি ডলারের মালিক বনে যাওয়া জ্যাক মা হলেন এশিয়ার বড় এক অর্থনৈতিক বিস্ময়। বিশ্বের ২২ তম বড় ধনী তিনি এখন। আলিবাবার পর কিছুদিন হলো জ্যাক মা আরেক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্ট’ নিয়ে শেয়ারবাজার মাত করতে নামছিলেন। এটা একটা মোবাইল পেমেন্ট সার্ভিস। ‘আলিপে’র মালিক।
ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে সবার জানা, অ্যান্টের আইপিওর আয়তন ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা একটা বিশ্ব রেকর্ড হতো। এ নিয়ে হংকং ও সাংহাইয়ের শেয়ারবাজারে রীতিমতো উত্তেজক ঝড় বইছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। কিন্তু ক্ষমতাসীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) তাতে বাদ সেধেছে। সেই আইপিও স্থগিত হয়ে গেছে।
এ ঘটনায় স্পষ্ট হলো, চীন পুঁজিতন্ত্রের ভেতর বড় আয়তনে মনোপলি তৈরি হতে দিতে অনিচ্ছুক। আলিবাবা এবং আরও একটি প্রতিষ্ঠান মিলে চীনের ই-কমার্সের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। এ রকম ঘটতে থাকলে অন্য ছোট ছোট সংস্থাগুলোর বিকাশ কঠিন হয়ে পড়তে বাধ্য। সিপিসি এ অবস্থাটা বদলাতে চাইছে। জ্যাক মা এখানে উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো, একচেটিয়া পুঁজিবাদ ঠেকানো।
পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রে চালকের আসনে থাকে, এই মিথেও আঘাত করেছে সিপিসি। রাষ্ট্রীয় এক ঘোষণায় জ্যাক মা এ মুহূর্তে প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে খুঁজছেন ভক্তরা।
আমেরিকা ও ইউরোপের সব দেশে বড় বড় কোম্পানির মনোপলির বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ আছে। কিন্তু কোনো দেশেই জনপ্রতিনিধিরা সাহসের সঙ্গে এ রকম বড় কোম্পানিগুলোর গায়ে হাত দিতে পারেনি বা সেটা চাইছে না। আমেরিকায় গত নির্বাচনের মনোনয়ন-যুদ্ধ থেকে স্যান্ডার্সকে যে থামিয়ে দেওয়া হলো, সেও তাঁর মনোপলি-বিরোধী অবস্থানের কারণে।

স্বভাবত আংকেল সির ‘অ্যাকশন’-এ দুনিয়াজুড়ে করপোরেটরা ভীত। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের কাছে এই ঘটনা দৃষ্টান্ত হতে বাধ্য। হয়তো এ কারণেই উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রচারমাধ্যমগুলো সিপিসির সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক তাৎপর্য আড়াল করে এটাকে সি চিন পিং বনাম জ্যাক মা দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখাতে চাইছে, যা আসলে ঐতিহাসিক এই ঘটনার মূল বার্তাই আড়াল করছে। আমাদের দেশের প্রচারমাধ্যমগুলোও তা-ই করছে। তারা এটাকে সিপিসির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং সি চিন পিংয়ের জ্যাক মা-বিরোধী আক্রোশ হিসেবে দেখাতে তৎপর। এ ধরনের বিশ্লেষণ হাস্যকর।
চীনের শাসন ও সেখানকার ক্ষমতাসীন দল অবশ্যই কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের। দেশটিতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংকট আছে। কিন্তু তার সঙ্গে সি চিন পিংয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্তকে মিশিয়ে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে পরিবেশন করা বিশ্লেষক ও সংবাদকর্মীদের দিক থেকে এক ধরনের অসততা। পাশাপাশি এটা সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লুকায়, পুঁজিতন্ত্র এবং এর কথিত ‘উদ্যোক্তা’দের জনপ্রতিনিধিরা বা ক্ষমতাসীনেরা চাইলে জনস্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এ রকম নিয়ন্ত্রণ যে দরকার, সেটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু সি চিন পিংকে সাধুবাদ দিতে রাজি নন কেউ। সিপিসির সর্বশেষ ঘটনা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির জন্য অবশ্যই একটা শুভ পদক্ষেপ।
সি চিন পিং স্পষ্টভাবে দেখালেন, রাজনীতি চাইলে করপোরেটদের রেগুলেট করতে পারে। তাদের একচেটিয়াত্বে আঘাত হানতে পারে। সম্পদের পুঞ্জিভবনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারে। সেই সম্পদশালীরা যত বড় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই হোক।
এসব বলার মানে আবার এও নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি সর্বোত্তম এবং তাতেই মানবসভ্যতার চলবে। কিন্তু এই ব্যবস্থার মধ্যে কী কী নিরীক্ষা হচ্ছে, সে বিষয়ে নির্মোহভাবে মনযোগ না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
জ্যাক মার ঘটনা বিশ্বজুড়ে হইচই তুললেও চীনের ভেতরে এ রকম আঁচ-অনুমান চলছিল অনেক দিন।

জ্যাক মা একসময় চীনের ‘পোস্টার বয়’ ছিলেন। কিন্তু আংকেল সি দেশটির সম্পদ কয়েকজন ‘বয়’ আর ‘গার্লে’র হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। ‘পার্টি’র তীব্র নজরদারি থাকবে তাতে। আলিবাবার নতুন সিইও কিন্তু চীনা সরকারের নতুন অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গত বছর ২০২১-এর জন্য দুটো অর্থনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যার একটা ছিল মনোপলি ভেঙে দেওয়া। দ্বিতীয়টা হলো, দেশের ভেতরে পণ্যের চাহিদা বাড়ানো। এ বছর থেকে চীনে নতুন পাঁচসালা পরিকল্পনার আরেকটা ধাপ শুরু হচ্ছে। কোভিডের ধাক্কা এবং আমেরিকার অপছন্দ সামলাতে দেশটি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এখন নিজ দেশের ক্রেতাদের সক্ষমতা বাড়াতে চাইছে। পাশাপাশি পুঁজি ও তার বিনিয়োগেও তারা কেন্দ্রীভূত প্রবণতা ভেঙে দিতে চলেছে। সব ধরনের অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে এ বছর কাজ করবে তারা। সে রকম কোনো অনিয়ম পেলে কোনো কোম্পানির বার্ষিক বেচাবিক্রির ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে রেগুলেটরি সংস্থা।
জ্যাক মা এসব আয়োজনে আহতদের তালিকায় প্রথম। তাতে করে আলিবাবা, জেডি ডটকমসহ চীনের বড় কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেশ পড়তে শুরু করেছে।
সিপিসি আসলে জ্যাক মাকে সামনে রেখে সর্বত্র একটা বার্তা দিল, রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্রকে জ্যাক মা মডেলের হতে দেবে না তারা। বার্তা হিসেবে এটা কৌতূহলোদ্দীপক এবং মনোযোগ দেওয়ার মতো। এটা চীনের অর্থনীতির কৌশলে একটা মোড় পরিবর্তন। বড় কোম্পানিগুলো বিগ ডেটার মাধ্যমে পরিস্থিতি মেনুপুলেট করছিল। মানুষ যত বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, ততই বিগ ডেটার ম্যানিপুলেশন সহজ হচ্ছে। কখনো কখনো ডিস্ট্রিবিউটরদের তারা কেবল নিজেদের কোম্পানির পণ্য বেচতে বাধ্য করছে। আবার জ্যাক মার ‘অ্যান্ট’ সামর্থ্যের অতিরিক্ত ঋণের ব্যবসাতেও নেমে পড়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, হাতে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করে এ রকম কোম্পানিগুলো মিডিয়া, ইনস্যুরেন্সসহ অন্যান্য খাতেও নামে।

সব খাতে তাদের আবির্ভাব সেসব খাতের নতুন এবং ক্ষুদ্রদের ব্যবসা কঠিন করে তোলে। এমনকি কোনো কোনো দেশে বিশেষ কোনো খাতে এক-দুটি কোম্পানির একচেটিয়াত্ব সরকারকেও জিম্মি দশায় ফেলে দেয়। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন খাতে এ রকম অবস্থা ঘটতে দেখেছি আমরা বিগত বছরগুলোতে। এসব বড় কোম্পানি সহজেই মিডিয়াকে কেবল প্রভাবিতই করে না, নিজেরাও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও খুলে বসে। জ্যাম মা-ও এসব পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন।
কিন্তু চীন তার অর্থনীতির মাঠকে নতুনদের জন্য সহজ এবং উপযোগী রাখতে চায়। এতে সমাজে উদ্ভাবনী উদ্যম যেমন বাড়ে, জাতীয়ভাবে অর্থনীতির ঝুঁকিও কমে। একটি-দুটি বড় কোম্পানিতে সংকট হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে তাতে বড় ঝাঁকুনি দেখা দেয় না। এভাবে চীন তার পুঁজিতন্ত্রের পরিসর আরও বড় ও টেকসই করতে চলেছে।
জ্যাক মা একসময় চীনের ‘পোস্টার বয়’ ছিলেন। কিন্তু আংকেল সি দেশটির সম্পদ কয়েকজন ‘বয়’ আর ‘গার্লে’র হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। ‘পার্টি’র তীব্র নজরদারি থাকবে তাতে। আলিবাবার নতুন সিইও কিন্তু চীনা সরকারের নতুন অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। বলা বাহুল্য, চাইলে রাজনীতি এভাবেই চালকের আসনে থাকতে পারে।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ চমৎকার উপমা দিয়েছে এ ক্ষেত্রে। ৬০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদশালী জ্যাক মাকে ১৮০০ ডলার বেতনভোগী সি চিন পিং যে চোখের পলকে জবাবদিহিতে ফেলে দিতে পারলেন, সেটা শক্তিশালী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের কারণেই।
কেবল বেসরকারি খাতের মনোপলি বন্ধ নয়, পাশাপাশি প্রায় সব খাতে অনুরূপ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়াচ্ছে চীন। এতে অর্থনীতির চাবিকাঠি কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে আটকে থাকবে না বলেই মনে করছে তারা। যা ‘পার্টির’ রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে টেকসই রাখতেও সাহায্য করবে।
পুঁজিতন্ত্রের মধ্যেও যে ক্রমাগত সংস্কারের সুযোগ আছে, তার একটা দৃষ্টান্ত দেখাল সিপিসি। একে অন্য দেশেরও অনুসরণের সুযোগ আছে। যদি কেউ অর্থনীতিতে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে চায়, তবে আপাতত গণচীন এগিয়ে থাকছে পুঁজিতন্ত্র নির্মাণে।


আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ