ট্রেনের টয়লেট ও একজন অখিলচন্দ্রের গল্প

ট্রেন সার্ভিস দেশের যাত্রী সেবায় বড় ভূমিকা রাখছে
ছবি: সংগৃহীত


ধরুন, আপনি চাপলেন ট্রেনে। আপনার চাপল বাথরুম। টয়লেটের খোঁজ নিলেন। জানলেন, এই ট্রেনে বাথরুম নেই। হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকের মামাকে (সদ্য প্রয়াত আলি যাকের এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন) হাজতে আটকে রাখার পর তাঁর যখন বাথরুম চেপেছিল এবং তিনি যখন জেনেছিলেন হাজতে বাথরুম নেই, তখন তাঁর যে দশা হয়েছিল, নিশ্চিতভাবে বলা যায় আপনারও তখন সেই দশা হবে। মামা বলেছিলেন, ‘হাজতে বাথরুম নেই—এটি একটি জাতীয় সমস্যা।'
হাজতে বাথরুম না থাকা যদি ‘জাতীয় সমস্যা’ হয়, তাহলে ট্রেনে বাথরুম না থাকা নির্ঘাত ‘আন্তর্জাতিক সমস্যা’। অখণ্ড ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা ১৮৪৫ সালের ৮ মে রেল চালু করার ৬০ বছর পর পর্যন্ত যাত্রীদের এই ‘আন্তর্জাতিক সমস্যা’ নিয়ে ট্রেনে চাপতে হয়েছে।
কোষ্ঠ সাফের পবিত্র আনন্দের সঙ্গে তুলনীয় একটি অতি বিনোদনমূলক কথা হলো, এখন সেই সমস্যা নেই। এখন ট্রেনে কারও বাথরুম চাপলে তিনি স্বচ্ছন্দে ফ্রেশ হয়ে আসতে পারেন। তবে যাঁর বদৌলতে আমরা ট্রেনে বাথরুম চাপামাত্র বাথরুমে যেতে পারছি, যাঁর একটি চিঠির জের ধরে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৯ সালে ভারতবর্ষের ট্রেনে টয়লেটের ব্যবস্থা করেছিল, সেই ব্যক্তির নাম অনেকেই জানি না। তিনি একজন বাঙালি। নাম অখিলচন্দ্র সেন।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের আহমদপুর স্টেশনের টয়লেটে গিয়েছিলেন অখিল। গার্ড ট্রেন ছাড়ার হুইসিল বাজিয়ে দিলেন। অখিল টের পেলেন ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ তাঁর ‘কাজটা’ তখনো শেষ হয়নি। তিনি ট্রেন ধরতে ‘হাফ ডান’ অবস্থায় শৌচাগার থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলেন। এক হাতে নিজের জিনিসপত্র ধরে, আরেক হাতে ধুতি সামলাতে সামলাতে দৌড়াতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে গেলেন। প্ল্যাটফর্ম-ভর্তি লোকের সামনে ধুতিটুতি খুলে গিয়ে বিতিকিচ্ছি অবস্থা!

অখিল ক্ষেপে গিয়ে সাহেবগঞ্জ ডিভিশনাল রেলওয়ে অফিসে ভুলভাল ইংরেজিতে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিটির সারকথা হলো, অতিরিক্ত কাঁঠাল খাওয়ার কারণে তাঁর পেট ফেঁপেছিল। তিনি কোষ্ঠ সাফ করে হালকা হতে গিয়েছিলেন। তিনি টয়লেটে যাওয়ার আগে গার্ডদের বলেওছিলেন। কিন্তু গার্ডরা তাঁর কথা মনে রাখেনি এবং ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, এ কারণে বহু নারী-পুরুষের সামনে তাঁকে হেনস্তা হতে হয়েছে। এ কারণে তিনি গার্ডদের জরিমানা করার দাবি জানান, নচেৎ সংবাদপত্রে খবর দিয়ে এই ঘটনা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন। অখিলচন্দ্র সেনের এই চিঠিটি রেলের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, ব্রিটিশ সরকার ওই চিঠির ভিত্তিতেই গোটা ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেয় যার জেরে ভারতে ট্রেনের মধ্যে বাথরুমের প্রচলন হয়। অখিলের সেই চিঠি এখনো দিল্লির রেল মিউজিয়ামে রাখা আছে।
অখিলের চিঠিতে ট্রেনে টয়লেট লেগেছিল ঠিকই কিন্তু সেই টয়লেটের বর্জ্য ধরে রাখার ট্যাংক ছিল না। চলন্ত ট্রেনে যাত্রীরা প্রাকৃতিক কাজ সারার সময় সব মলমূত্র ট্রেনলাইনেই পড়ছিল। তার পর এক শ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে কিন্তু সেই অবস্থা থেকে আধুনিক ভারতও পুরোপুরি বের হতে পারেনি।

স্বাধীন বাংলাদেশ তো পারেইনি। অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গে (এখনকার বাংলাদেশে) রেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। তার মানে ১৩৮ বছর ধরে মনুষ্য বর্জ্য রেল লাইনে প্রতিনিয়ত পড়ছেই।
সভ্য দুনিয়ায় ট্রেনে নানান ধরনের ট্যাংক স্থাপন করে বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো অনেক ট্রেনে ভ্যাকুয়াম টয়লেট ব্যবস্থাপনা আছে। অনেক সময় ট্রেন এবং প্লেনের ক্ষেত্রে রাসায়নিক শৌচাগারের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। রেল লাইনে যাতে মলমূত্র না পড়ে সে জন্য ভারত ইতিমধ্যে লক্ষাধিক ট্রেনে বায়ো টয়লেট সংযোজন করেছে।
খবরে দেখেছি, আমাদের দেশেও ঢাকা-রাজশাহী বিরতিহীন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেনে অত্যাধুনিক বায়ো টয়লেট যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে মল-মূত্র আর রেললাইনে পড়বে না।

তবে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিটের একজন সাংবাদিকের ভাষ্য, এসব উদ্যোগ দেখে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। এসব প্রকল্পের আসলে চমক দেখানোই সার, এ সবই প্রকল্পের নামে পয়সা হাতানোর ফন্দি। তিনি মনে করেন, নতুন নতুন প্রকল্প আসবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর সব ট্রেনে বায়ো টয়লেট স্থাপনও নাকি বিরাট ব্যয়সাধ্য ব্যাপার।
রেলওয়ের আইনে বলা আছে, রেললাইনের দু’পাশের ১০ ফুট এলাকার মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে।
অনেকে যুক্তি দিতে পারেন, যেহেতু রেললাইন সার্বক্ষণিক ১৪৪ ধারার আওতাধীন, সেহেতু ট্রেনের টয়লেটের মলমূত্র রেল লাইনে পড়লেও তা মানুষের উপস্থিতি থেকে দূরে থাকে। তাই অসুবিধার কারণ নেই। কিন্তু যে দেশে নীতিশিথিল জীবন যাপনের অভ্যাস ও চর্চা শিল্পোত্তীর্ণ রূপ নিয়ে আছে, সেই দেশে পাবলিককে এই আইন মানানো কঠিন। আর সেটা কঠিন বলেই আমাদের দেশে রেললাইনের ওপরই নিয়মিত বাজার বসে। রেললাইন ঘেঁষে লোকালয় থাকে। ট্রেনের টয়লেটের এসব মলমূত্রকেই নিত্যদিনের ‘উপহার’ মেনে নিয়ে এসব ট্রেন লাইনসংলগ্ন বাসিন্দাদের জীবন পার করতে হয়।

আমাদের দেশ ছোট। জমি কম। মানুষ বেশি। সুতরাং আইন দিয়ে রেল লাইনের দুই পাশকে সার্বক্ষণিক ১৪৪ ধারায় রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু যে রেল বিভাগে ফি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসানি গুনতে হয়, সেখানে যদি ট্রেনের মলমূত্র ব্যবস্থাপনার জন্য আরও কয়েক শ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় তাতে ক্ষতি কী? তাতে অন্তত পুঁতিগন্ধময় রেল লাইনের হাত থেকে মানুষ বাঁচতে পারত। তার জন্য কি অখিলচন্দ্রের পুনরুত্থান দরকার?


সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]