ডুবেও মরণ, পানি বিহনেও মরণ

খুলনা থেকে মংলায় যাওয়ার মসৃণ পথ ধরে যেতে যেতে মংলার ১২ কিলোমিটার আগেই চোখে পড়ল কৌতূহলজাগানিয়া দৃশ্য। সার বেঁধে হেঁটে চলেছে কলসি কাঁখে মেয়েরা। কলসির সঙ্গে আছে দেড়-দুই হাত লম্বা প্লাস্টিকের নল। দু-একজন পুরুষের মাথায়ও পানির কলসি বা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের গ্রামের দিকে হেঁটে চলেছেন তাঁরা। কেউ কেউ গ্রাম থেকে খালি কলসি বা হাঁড়ি নিয়ে ছুটছেন। জানা গেল, খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য এই অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের অনিবার্য লড়াইয়ের দৃশ্য এটি। মংলা সড়ক থেকে নেমে গ্রামগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। গ্রামের নাম টেংরিমারি। তারপর জয়নগর, পাশেই পিপুলবুনিয়া। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার শেষ প্রান্তের গ্রাম এগুলো।
তখন খাড়া দুপুর। মাথার ওপরে আগুন ঢেলে দিচ্ছে গ্রীষ্মের গনগনে সূর্য। ভাপসা হাওয়ায় ঘেমে ওঠা শরীরে অসহনীয় অনুভূতি। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে আসছিল। একজনকে বলতেই জগ থেকে পানি ঢেলে দিল গ্লাসে। গরম আর লোনা। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে কায়ক্লেশে সংগ্রহ করা সেই পানি। গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পথের নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর পানির আউটলেট পয়েন্ট। পাঁচ কিলোমিটার দূরের ট্যাংক থেকে পানি আসে পয়েন্টগুলোয়। এক দিদি একটা পয়েন্টের কাছে নিয়ে গেলেন। কলের মুখ খোলা। ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। কলের মুখের চারদিকে কলসি আর হাঁড়ির সমাবেশ।
চারদিকে তাকালে মনটা ভরে যায়। প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে অপার সৌন্দর্য। ম্যানগ্রোভ গাছগাছড়া ছড়িয়ে আছে সবদিকে। জমির পর জমিগুলোয় হাঁটুপানি, ছিপছিপে লবণাক্ত পানি। প্রখর দুপুরে সেখান থেকে শ্বাসরুদ্ধকর ভাপ উঠে আসছে। আগুনের হলকা লাগছে গায়ে। এগুলো সব চিংড়িঘের। দক্ষিণ বাংলার সোনার খনি! ঘেরগুলো অবশ্যই ঘেরের মালিকদের সমৃদ্ধি দিয়েছে খুব অল্প সময়ে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কিছুটা হলেও অবদান রেখেছে। তবে ঘেরের মালিকেরা রামপালে থাকেন না।
গোলপাতায় ছাওয়া এক ঘরে আশ্রয় নিলাম। বাইরের কাঠফাটা গরম সত্ত্বেও গোলপাতায় ছাওয়া ঘরের তাপমাত্রা এতটা আরামদায়ক হতে পারে, জানা ছিল না। সেখানেই কথা হচ্ছিল জয়নগর-পিপুলবুনিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে। খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের সংস্কৃতি জগতে, খেলাধুলায় এখানকার তারুণ্যের খ্যাতি আছে। কিন্তু তাঁরা এখন বুঝে গেছেন, হয়তো এই জন্মভিটায় আর বেশি দিন থাকতে পারবেন না তাঁরা। আগে পুকুরের পানিতে গোসল, কাপড় ধোয়া হয়ে যেত অন্তত। এখন পুকুরের পানিতে হাত দিলে হাত জ্বলে। গা চুলকায়।
গত আইলার পর থেকে এই অঞ্চলে টিকে থাকাই দুঃসহ হয়ে উঠেছে। টিউবওয়েল বসানোর সরকারি-বেসরকারি নানা চেষ্টাই হয়েছে। ১২০ ফুট পাইপ বসিয়েও যে পানি উঠে আসে, তাতে আর্সেনিক বিষ। ব্যবহার করলে শরীরের এখানে-ওখানে ফুসকুড়ি উঠে চামড়া, মাংস পচে যাওয়ার মতো হয়। বর্ষার পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে গ্রামবাসী। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হতে না-হতেই শুরু হয় চরম সংকট। সমস্যা অন্তহীন। ভূমির ওপরে সবই লবণাক্ত, ভূগর্ভে আর্সেনিক।
শুরুতে বলেছিলাম, পানি সংগ্রহ করতে হয় দূর থেকে, যেতে হয় হাতে কলসি আর এক টুকরা ছোট পাইপ নিয়ে। এর কারণ, খুলনা থেকে মংলা বন্দরে টেনে নিয়ে যাওয়া পানির পাইপলাইন বিশেষ দক্ষতায় ফুটো করে ছোট প্লাস্টিক পাইপ ঢুকিয়ে পানি নিয়ে আবার নিখুঁতভাবে বন্ধ করে দেয় এলাকাবাসী। কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে এভাবে পানি সংগ্রহের ঝুঁকি তাদের নিতেই হয়; এর বিকল্প নেই এলাকাবাসীর। তবে সুপেয় পানির সংকট কেবল রামপালেই নয়, দক্ষিণের উপকূলবর্তী সব ঘেরসমৃদ্ধ এলাকাতেই। টেংরিমারি-জয়নগর-পিপুলবুনিয়ার মতো এলাকাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন উদ্যোগ তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিযোগ ঘটালেও, দীর্ঘ মেয়াদে তা ধ্বংস করে দিতে পারে একটি অঞ্চলের বাসযোগ্যতা। এই পরিস্থিতিতে রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তাতে আমাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ চাহিদার অনেকখানি মিটবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সংলগ্ন বন, কৃষি, নদীসহ জলজ সম্পদ, বসতি ও জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির কারণও হবে এই বড় উন্নয়ন উদ্যোগ।
এখানকার মানুষ আতঙ্কে আছে। সাগরের লোনাপানি প্রবেশ করে গ্রাম সয়লাব করে দেবে। আইলার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে উঠবে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ারও উপায় থাকে না রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে না আসা পর্যন্ত। এখানকার মানুষের যেন পানিতে ডুবেই মরণ, আবার পানি বিহনেও মরণ।
কথায় কথায় মালতী মণ্ডল নামের এক মধ্যবয়সী নারী বিনয় সরকারের গান গেয়ে উঠলেন। অতি বিষণ্ন সুর। তারপর তিনি নিজের রচিত গানও শোনালেন। শত ঝুঁকির মধ্যেও জয়নগরেই থেকে যেতে চান। কষ্ট আর ঝুঁকি সত্ত্বেও নাড়ির টান ছিন্ন করতে কে-ই বা চায়। কিন্তু খাওয়ার পানির পেছনে পরিবারের আয়ের বড় অঙ্ক ব্যয় করে কত দিন টিকবে উপকূলবর্তী গ্রামবাসী?
অন্তত খাওয়ার পানির নিশ্চয়তা ছাড়া লোনাপানিতে দিশেহারা একটি জনপদ কীভাবে রক্ষা পাবে? কেবল পানি বিশেষজ্ঞদের ভাবনায় ফল হবে না। সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের জ্ঞান কাজে লাগিয়েই এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
[email protected]