তপ্ত শীত এবং সামান্য ক্ষতি!

কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। এবারের পৌষে চারপাশে হাঁসফাঁস অবস্থা। শীত আছে, কিন্তু রাজনৈতিক উত্তাপে পুড়ছে সব। রাজনীতির আগুনে দগ্ধ গীতা সেনের ভাষায় ‘অসুস্থ’ রাজনীতি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এখন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সবাই যেন গৃহবন্দী হয়ে আছে। সব সময়ই ভয়, যদি কিছু হয়। কখন কার অবস্থা ‘শান্ত’র মতো হয়, কেউ বলতে পারে না। শান্তও এই শীতে তৃতীয় শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা শেষে মা আর ভাইকে নিয়ে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুলের সামনে ১৩ ডিসেম্বর সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে শান্ত।
শান্তর বাবা সোবাহান ব্যাপারীর আর্তনাদ এখনো কানে বাজে: ‘আমার পোলাডার...শরীরে কতগুলা গুলি? এইভাবে কেউ কি কেউরে মারে?’ শান্তর মায়ের বিলাপ: ‘আমার ছেলে তো কোনো অন্যায় করে নাই। কেন তারে এইভাবে হাসপাতালে শুইয়া থাকতে হইতেছে? এর জবাব কি কেউ দিতে পারব?’ দেশের এ অবস্থায় এই প্রশ্ন আজ অনেকের। বিশেষ করে, যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে? কেউই তো দায়িত্ব নিচ্ছে না, কেবল দোষ চাপিয়েই খালাস।
অচলাবস্থায় শুধু সচল আছে রাজনীতি। ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার মমতাহীনতাই কি রাজনীতি? অথচ জনগণই নাকি সকল ক্ষমতার উৎস। দুই পক্ষই ১৬ কোটি জনগণের দোহাই দিচ্ছে! দুই পক্ষেই যদি সমহারে জনগণ থাকে, তবে এ দেশের জনসংখ্যা এখন ৩২ কোটি হওয়ার কথা। প্রতিদিন মানুষ মরছে। কারা মরছে, কীভাবে মরছে, তা অনেকেই জানতে পারেন না। অজানা-অচেনাদের বলা হয় অজ্ঞাতপরিচয়, আর তারাই হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, ক্ষমতার উৎস! অথচ অসাধারণ (!) কেউ যদি হাতে কিংবা হাঁটুতে একটুখানি চোট পান, তাহলে ২৪টি চ্যানেলে যেমন ব্রেকিং নিউজ ভেসে আসে, ‘উনি আহত হয়েছেন’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণের মৃত্যুর চেয়ে কথিত সেবকের একটু চোট পাওয়ার গুরুত্বই যেন বেশি। রাজনীতিকেরা বলেন তাঁরা জনতার সেবক। অথচ সেই জনগণকে নিয়ে কারও কোনো ভাবনা আছে, তা বর্তমান বাস্তবে অন্তত দৃশ্যমান নয়।
একটি জনপ্রিয় গানের পঙিক্ত, ‘মানুষ মানুষকে জীবিকা করে, মানুষ মানুষকে পণ্য করে’। সাধারণ মানুষ আজ রাজনীতির পণ্য। তাদের ব্যবহারের বিধিও একেক পক্ষের একেক রকম। দুই পক্ষ উত্তপ্ত বক্তব্য দিচ্ছেন, আর পিটুনি খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কাঁদানে গ্যাসে কাঁদছেন সাধারণ মানুষ। ক্যাডারদের পিস্তল বা চাপাতির আঘাতে জর্জরিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দুর্ভাগ্য, ‘সাধারণ মানুষের কোনো দল নেই’। তারা নির্বাচনে দাঁড়ান না। দাঁড়াতে পারেন না। কোনো টক শোতে তাঁদের অতিথি করা হয় না। তাঁদের কোনো বিবৃতি ছাপা হয় না পত্রিকায়।
সাপ ফোঁস ফোঁস করে, নইলে কেউ হয়তো তাকে কেঁচো ভাবতে পারে। যে সাপই কীটপতঙ্গ খেয়ে বেড়ায়, মৃত্যু হলে আবার কীটপতঙ্গই সাপকে খায়। তাই কারও নিজেকে সাপ ভেবে ফোঁস ফোঁস করা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষ জেগে উঠলে তাঁদের ক্ষমতার কাছে সবাইকে হার মানতে হবে।
রাজনৈতিক বিভাজন ডালপালা বিস্তার করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে। টক শোগুলো দেখলে এই বিভাজনের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা যত যুক্তিতর্কই উপস্থাপন করি না কেন, দৃশ্যমান সত্যি হচ্ছে, দেশ অশান্ত, দেশ অচল। ফসল বিক্রি করতে না পারায় কৃষকেরা দিশেহারা। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ধ্বংসের পথে, শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সারা পৃথিবী আমাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখে হাসাহাসি করছে। অনেক আনুষ্ঠানিকতাও তারা বর্জন করছে।
সাধারণ মানুষকে বোঝালে বোঝে, কিন্তু অসাধারণ দুই পক্ষকে বোঝানোর ক্ষমতা বোধকরি কারোরই নেই। প্রয়োজন পড়ে তৃতীয় পক্ষের। স্বদেশি হলে চলবে না, হতে হবে বিদেশি! বড় দুটি দলকে একত্রে বসানোর জন্য সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সমাজ কতই না চেষ্টা করল! সবাই ব্যর্থ হওয়ার পর এলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত মি. তারানকো। বেচারা তারানকো বেশ কদিন চেষ্টা করে অন্তত আলোচনায় বসাতে সক্ষম হন। তবে এটুকু কাজ করতে গিয়ে এই শীতেও তিনি কী পরিমাণ ঘর্মাক্ত হয়েছেন, তা তো আমরা টিভিতেই দেখেছি। শুধু তা-ই নয়, দুই পক্ষের কেউই কারও স্থানে গিয়ে বসবেন না। সেটাও বসতে হলো বিদেশিদের কোনো অফিসে গিয়ে। তারানকো আশার বাণী শুনিয়ে গন্তব্যের পথে ছুটলেন, আর আমরা ছুটলাম গন্তব্যহীন পথে। অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষও কোনো কাজে এল না।
আমরা চাই না মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হোক। শান্তিতে সুনাম অর্জনকারী দেশটি নিজেই অশান্তির আগুনে পুড়তে থাকুক। চাই না ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হোক জনস্বার্থ। রাজনীতির অসুস্থতায় মৃত্যুশয্যায় ছটফট করুক জাতি। আবার এটাও চাই না বিরাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্র মিশে যাক ধুলোয়। তাই প্রয়োজন সুস্থ রাজনীতির, প্রয়োজন সুস্থ রাজনীতিকের। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে, কিন্তু তা যেন দেশবিরোধী না হয়। দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সংসদে নিজের প্রতিনিধি পাঠাতে অবাধ ভোটাধিকার যেন গুরুত্ব পায় সবচেয়ে বেশি। পেশিশক্তি বেশি শক্তি নয়, দেশি চেতনার উন্মেষই বড়। শীতে খড়কুটো
জ্বেলে আগুন পোহানো ভালো, আগুন লাগানো নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কাশীর মহিষী নদীতে স্নান শেষে কৃষকের পর্ণকুটিরে আগুন দিয়ে শীত নিবারণ করেছিলেন। তাঁর শীত নিবারণের তুলনায় এটা ছিল সামান্য ক্ষতি, কিন্তু কৃষকের কাছে ছিল সর্বস্ব হারানো। রাজমহিষী তা না বুঝলেও রাজনীতিকদের তা বোঝা উচিত। কারণ, এ দেশ রাজতন্ত্রের নয়, গণতন্ত্রের।
হানিফ সংকেত: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, লেখক।
[email protected]