তরুণদের প্রাণের আকুতি শুনুন

.
.

আমাদের তরুণদের আকাঙ্ক্ষা আছে, আনন্দ আছে, বেদনাবোধ আছে, অনুভূতি আছে, দুর্দমনীয় সাহস আছে—নেই শুধু সেসব কাজে লাগানোর সুযোগ ও সামর্থ্য। এ সমাজ তরুণদের সঠিক মূল্যায়ন করতে অক্ষম। ক্ষমতাবানেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটাই মশগুল যে সাধারণ মানুষ তথা তরুণদের নিয়ে ভাবার ফুরসত পান না।
আমাদের তরুণেরা দেশে কাজ পান না। তাই জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে বহু কষ্টে বিদেশে পাড়ি জমান ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু সেখানেও নানা রকম হয়রানির শিকার হন। ধারদেনা শোধ করে যখনই ভবিষ্যতের কথা ভাবেন, তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘোষণা আসে, চাকরি নবায়ন করা হবে না, দেশে ফিরে যেতে হবে।
জানতে পারলাম, কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবেই এই দুর্ভোগ। হায়, দুর্ভাগা দেশ! লাখ লাখ প্রবাসী তরুণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, সেই অর্থেরও সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না। সেটি হলে তাঁদের প্রবাসজীবনের কষ্টকে কষ্ট বলে মনে হতো না। তাঁরা ভাবতেন, দেশের জন্য কিছু করতে পারছি। প্রবাসীদের কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে উৎপাদিত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ কমছে। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না, নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
এভাবে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। নিজ দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে কলকারখানা গড়ে তুলে উৎপাদিত দ্রব্য নিজ দেশে ভোগ এবং বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে দেশে বেকারত্ব কমত।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর পড়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, আবেগে আপ্লুত হতে হয়। এই সংবাদটুকু থেকে আমাদের কিছুই শেখার নেই? গতানুগতিক ভাবধারার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। রাজনীতিকদের জীবনধারণের প্রণালি দেখলে মনে হয়, তাঁরা সম্পদের প্রতিনিধি, জনগণের নন।
দেশ যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারত, তাহলে তরুণদের চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে বঙ্গোপসাগরে আত্মাহুতি দিতে হতো না। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় চাকরির জন্য যেতে হতো না। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান, উত্তাল তরঙ্গ, কালো মেঘে ছাওয়া আকাশ, অথই জলরাশি—সে এক ভয়াবহ অবস্থা! ভাবতে পারেন সেই অবর্ণনীয় কষ্টের কথা? যাঁরা আরামে আছেন, আয়েসে আছেন—তরুণদের সেই দুঃসহ কষ্টের বাষ্প এসব সুখী মানুষকে স্পর্শ করে না। এই তরুণদের অনেক সময় ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হচ্ছে অথবা সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে সলিলসমাধি হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট লাগে, যখন কোনো প্রতিকার খুঁজে পাই না।
প্রসঙ্গক্রমে আমি শুধু একটি বছরের বেকারত্বের চিত্র তুলে ধরব। ১৯৯৬-৯৭ সালে শ্রমশক্তি ছিল ৪২ দশমিক ৯৭, সেখানে অভ্যন্তরে নিয়োগ পায় ২১ দশমিক ৬২ এবং বিদেশে কর্মসংস্থান হয় ১ দশমিক ৩৪, মোট কর্মসংস্থানপ্রাপ্তির সংখ্যা ৩০ দশমিক ৯৬ এবং বেকারত্বের হার হয় ২৭ দশমিক ৯৫।
এই যখন আমাদের দেশের চিত্র, তখন বেঙ্গালুরুভিত্তিক সিলিকন ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন এক তথ্য প্রকাশ করেছে: ৩ দশমিক ৭১৬ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের মতো গরিব দেশ থেকে ভারত নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম প্রবাসী আয়ের উৎস। এখন পাঁচ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে বসবাস করছে বলে উল্লেখ রয়েছে। বেশির ভাগই তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্পে কর্মরত। হতে পারে ভারতের শ্রমিকেরা আমাদের তুলনায় দক্ষ। তাহলে আমরা কেন আমাদের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি না, তাঁদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলছি না?
দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সবকিছুই করা সম্ভব। তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্প—এই দুই সেক্টরে শ্রমশক্তি বিদেশ থেকে আমদানি কোনোক্রমেই দেশের স্বার্থের অনুকূলে নয়। স্বাধীনতার লক্ষ্য যে ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, তা আমরা কতটা অর্জন করতে পেরেছি? স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও রাজনৈতিক অঙ্গন যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হচ্ছে। তার পরও আমরা আশাহত হতে চাই না। আমরা স্মরণ করি আমাদের প্রেমে ও রণে সততজয়ী কাজী নজরুল ইসলামের তারুণ্যের জয়গান। ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের একটি সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একমাত্র সম্বল আপনাদের তরুণদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা প্রাণের টান।’
তাই আমাদের সত্য উপলব্ধি করার সময় এসেছে। আমরা কি কেবল পুরোনোকে আঁকড়ে পেছনের দিকে যাব, নাকি সব তরুণকে একতাবদ্ধ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব? সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলে পুরো জাতিকে তার মাশুল দিতে হবে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সাধনে তরুণেরা সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহূত হবেন না। তারুণ্যের রঙে উদ্ভাসিত কবি সুকান্তের একটি কবিতা যেন আমাদেরই মনের কথা বলে: ‘আমরা সিঁড়ি,/ তোমরা আমাদের মাড়িয়ে/ প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,/ তারপর ফিরেও তাকাও না (আমাদের) পিছনের দিকে;’।
পরিশেষে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য সম্ভাবনাময় আলোর দ্বার খুলে যাবে—এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।
সৈয়দা নীলুফার: কলেজশিক্ষক।