তাদেরও বলার কিছু থাকতে পারে

বাংলাদেশে বহুল আলোচিত সামাজিক সমস্যার নাম বাল্যবিবাহ। নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বাল্যবিবাহকে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচনা করেন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আইসিডিডিআরবি এ সম্পর্কে গত বছর যে জরিপ ফলাফল প্রকাশ করেছে, তাতে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। গবেষণা বলছে, এ দেশের ৬৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর হওয়ার আগেই। এমনকি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েদের ২৬ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই, আর ৮৬ ভাগ নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শিশু বয়সে। গত অর্ধদশকে অন্য যেসব গবেষণা ফলাফল জানা যায়, তাতে এই চিত্র প্রায় স্থির হয়ে আছে।
অথচ সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়েই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একধরনের আপসহীন সংগ্রামের কথা প্রচারিত। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি যখন বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠেছে, তখন এই চিত্র অবশ্যই হতাশাজনক। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নারীর প্রতি সহিংসতা, প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি, যৌন হয়রানি ইত্যাদিকে বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষার বিষয়বস্তু ও মান একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কিশোরীদের নিরাপত্তাহীনতাও বাল্যবিবাহ টিকিয়ে রেখেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অসহায় অভিভাবককে এই অপরাধ করতে বাধ্য করছে। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকেরা স্বেচ্ছায় বাল্যবিবাহ ঘটাচ্ছেন ‘মেয়ের বয়স হয়ে গেলে বেশি যৌতুক দিতে হবে’ এই আশঙ্কায়। এবং এই আশঙ্কা অমূলক নয়। যৌতুক অতি সাধারণ ঘটনা। কেউ যৌতুক দেন দাবির মুখে, কেউ উপহার দেওয়ার নাম করে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৫ বছর তিন মাস। ছেলেদেরও যে শিশু বয়সে বিয়ে হচ্ছে না, তা নয়। ইউনিসেফ বলছে, ৫ শতাংশ বাংলাদেশি ছেলের বিয়ে হয় শিশু বয়সে। তবে বাল্যবিবাহের কুপ্রভাব মেয়েদেরই আক্রান্ত করে দৃশ্যমানভাবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের শিক্ষায় যে উন্নতি দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার এই প্রবণতার পেছনে বাল্যবিবাহই মূলত দায়ী। তবে বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারে চালু আছে। কিন্তু তাতে বালিকা বধূকে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়া, পুষ্টিহীনতা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। নারীর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ তাতে রুদ্ধই থাকছে।
বাল্যবিবাহ বন্ধে এ ধরনের বিবাহ সংঘটকদের এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে সেই ১৯২৯ সালের (১৯৮৪ সালে সংশোধিত) ঔপনিবেশিক কালের আইনে। এই লঘু দণ্ডটিও প্রয়োগের উদাহরণ অপ্রতুল। অধিকন্তু স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বয়স প্রমাণের জন্য সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। ফরম কিনে ইচ্ছামতো জন্মতারিখ লিখে কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেই স্বাক্ষর মেলে অনায়াসে। সুতরাং কাজিদের জন্য এটা কাগজে-কলমে যুক্তি দেখানো সহজ যে তাঁরা বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রি করছেন না! এ ক্ষেত্রে আইনজীবী সালমা আলীর মতানুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শতভাগ বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, তেমন কথাও হলফ করে বলার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি, এ বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন আছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন হতে যাচ্ছে। সুখবর নিশ্চয়ই। গত ১০ ফেব্রুয়ারি এই আইন নিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অ্যানাবলিং এনভায়রনমেন্ট ফর চাইল্ড রাইটস প্রকল্প একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উর ইসলাম বলেছেন, ‘আইনটি এমনভাবে করা হবে, যেন আগামী ১০০ বছরের মধ্যে তা আর সংশোধন করতে না হয়।’ (প্রথম আলো, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)
এতে মনে হতে পারে যে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত, আগামী ১০০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে দেশে বাল্যবিবাহের মতো অপরাধ ঘটতেই থাকবে। সরকারের পাশাপাশি অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা এই সামাজিক সমস্যা নিরসনে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে যা যা বিধিবিধান থাকছে, তা কি বাল্যবিবাহের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা জানেন? আইন যখন তৈরি হয়, তখন সে আইনে সম্ভাব্য উপকারভোগীদের মতামতের প্রতিফলন থাকা গণতন্ত্র চর্চারই অংশ। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আইনের ক্ষেত্রে কেন সেটা করা হচ্ছে না, তা প্রশ্নবোধক বটে। কেবল সমাজকল্যাণ কেন, আইন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—সবার মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করেই এই জনগুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা উচিত।
তা ছাড়া এই আইনে অভিযোগ করার দায়িত্বপ্রাপ্তরা, সরেজমিনে তদন্তকারীরা, জনমত গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা, প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণের কর্তৃপক্ষ যদি দায়িত্বে অবহেলা করে, তো তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা থাকবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনাও থাকা দরকার। আইনে অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তার কোনো সংজ্ঞাও দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, আইন বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন, বাল্যবিবাহের কারণগুলোও এই আইন দ্বারা প্রতিহত করার সুযোগ আছে কি না। সমস্যাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার
চেয়ে সমস্যার পেছনের কারণগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা বেশি কার্যকর বলেই মনে হয়।
টাকার মূল্য বা এই অপরাধের মাত্রা যে রূপই পাক, অপরাধ প্রমাণিত হলে শত বছর ধরে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড (প্রস্তাবিত বর্তমান আইন) বহাল থাকবে! বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সংসদে অনুমোদিত হওয়ার আগে তৃণমূলে সম্পৃক্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। বাল্যবিবাহের বিষয়ে মামলা করার অভিজ্ঞতা লাভকারী ব্যক্তিদেরও বলার মতো কথা থাকতে পারে।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।