তুরস্কের বিরুদ্ধে ফ্রান্স এত বেপরোয়া কেন?

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও এমানুয়েল মাখোঁ
রয়টার্স ফাইল ছবি

আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের মালিকানা নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। উভয় পক্ষই নিজেদের সামলে নিয়ে আলোচনার টেবিলে আপন আপন দাবির যৌক্তিকতা প্রকাশের প্রস্তুতি নিলেও আকস্মিক সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকছেই। কারণ ফ্রান্সের ক্রমাগত উসকানি ও হুমকি সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি করে রেখেছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দেশ না হয়েও ফ্রান্স এই বিবাদের পক্ষে। এই পক্ষ প্রদর্শন শুধুই অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও। আফ্রিকা মহাদেশে ফ্রান্সের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখতে আঙ্কারাকে এখনই থামাতে চায় প্যারিস। সিরিয়া আর লিবিয়ার পর আর কোনো রাজনৈতিক ‘পরাজয়’ মানতে রাজি নয় প্যারিস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোটা দাগে মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকা মার্কিনদের, দক্ষিণ এশিয়া ব্রিটিশদের এবং আফ্রিকা ফরাসিদের নিয়ন্ত্রাধীন অঞ্চল বলে অলিখিত সমঝোতা ছিল। উপনিবেশবাদের প্রভাবে উল্লেখিত এসব অঞ্চলের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনবোধে এই পশ্চিমা দেশগুলোর বিপুল প্রভাব দৃশ্যমান। তবে নতুন শতাব্দীতে মার্কিনদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে এই প্রবাদে যোজন–বিয়োজন ঘটেছে। ইউরোপ এবং মার্কিনিদের পাশাপাশি রাশিয়া, চীন এবং স্বল্প পরিসরে ভারত এবং তুরস্কের উত্থান অলিখিত এই ‘সমঝোতায়’ ভাঙন ধরিয়েছে। আর এটা গুরুতর আকার নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা মহাদেশে। সমাজের উঁচু মহলের পুঁজিপতিদের দৈনন্দিন জীবনে ফরাসি প্রভাব থাকলেও বাণিজ্যে চীন ও ভারতের পাশাপাশি তুরস্কও শক্তিশালী জায়গা করে নিয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকায় চীনের প্রভাব এখনো বড় বড় দালানের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক কক্ষে আবদ্ধ, কিন্তু ভারত তার চলচ্চিত্র এবং তুরস্ক তার টিভি সিরিয়াল এবং সামাজিক কার্যক্রম নিয়ে জনমনে তুমুল আবেদন সৃষ্টি করেছে, যা ফরাসিদের দীর্ঘদিনের নিগূঢ় বর্মে ফাটল ধরিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে ভারত, ঠিক একইভাবে লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সোমালিয়ায় তুরস্কের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সামজিক প্রভাব অখণ্ডনীয়।

গত অক্টোবরে তুরস্ক-সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কুর্দি পিকেকের অবস্থান নিয়ে মার্কিনদের সঙ্গে চুক্তির পরের সপ্তাহেই মস্কোয় উড়াল দিয়েছিলেন এরদোয়ান। মস্কোতে পুতিন এবং এরদোয়ানের মধ্যে সমরূপ চুক্তি হয়। কারণ মার্কিনদের সঙ্গে সঙ্গে রুশরাও পিকেকের বড় সমর্থক। চুক্তির দরুন রুশ ও মার্কিনদের নির্দেশনায় পিকেকে তুরস্ক-সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল ছেড়ে সিরিয়ার ভেতরে চলে যায়। ফরাসিদের পাশ কাটিয়ে রুশ ও মার্কিনদের সঙ্গে আঙ্কারার এই চুক্তি প্যারিসে ব্যাপক অসন্তুষ্টির জন্ম দেয়। প্রেসিডেন্ট মাখোঁসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তা বারবার প্রকাশ করেছেন। ফরাসিরা পিকেকের জন্মলগ্ন থেকেই আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। তাই ফরাসিদের আশা ছিল, আঙ্কারা যেভাবে রুশ ও মার্কিনদের সঙ্গে চুক্তি করেছে অনুরূপভাবে একই চুক্তি ফরাসিদের সঙ্গে স্বাক্ষর করবে। কিন্তু প্যারিসের কোনো আহ্বানেই আঙ্কারা সাড়া দেয়নি। সিরিয়ায় এই রাজনৈতিক পরাজয়ের পর ফরাসিরা সৌদি বলয়কে সঙ্গে নিয়ে লিবিয় জেনারেল হাফতারকে উসকে দিয়ে ত্রিপলির দখল নিয়ে স্বৈরাচারের উত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক-কাতার বলয়ের দ্রুত হস্তক্ষেপের দরুন হাফতার অবশেষে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্রমাগত ফরাসি পরিকল্পনায় ছেদ পড়ার কারণে প্যারিস পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে তুরস্কের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে জায়গা করে নেওয়ার কৌশলকে থামাতে চায়।

উত্তর আফ্রিকায় আঙ্কারাকে থামাতে যেভাবে সৌদি বলয়কে পাশে পেয়েছিল ফরাসিরা, ঠিক একইভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আঙ্কারাকে মোকাবিলায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সামগ্রিকভাবে পাশে পায়নি। যদিও ফরাসিদের পক্ষ থেকে বারবার ইউরোপের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ডাক দেওয়া হয়েছে এবং শুরু থেকেই এই বিবাদকে তুরস্ক বনাম ইউরোপের বিবাদে রূপ দেওয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের পূর্ণাঙ্গ সাড়া না পাওয়ায় তারা ভিন্ন পথ নেয়। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ফরাসি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া পড়া গ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমেছে প্যারিস। গ্রিসের সমুদ্রসীমা রক্ষা করতে গিয়ে ফরাসিরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ এবং রাফায়েল যুদ্ধবিমান মোতায়েনসহ আন্তর্জাতিক চুক্তি ডিঙিয়ে গ্রিক সাইপ্রাসে যুদ্ধবিমানের ঘাঁটি বানিয়েছে। এই মারমুখী অবস্থা নিয়ে ফরাসিরা মূলত ন্যাটোর ক্ষতি করেছে এবং এর ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখোমুখি করেছে।

গ্রিস ও তুরস্ক উভয় দেশই ন্যাটো সদস্য। তাই আলোচনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের সুযোগ ছিল। পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ফরাসিরা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সঙ্গে না পেলেও আরবদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তুরস্কের বিপক্ষে। গঠন করেছে আঞ্চলিক জোট এবং আরব আমিরাত গ্রিসের সহযোগিতায় নিজস্ব এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে গঠিত পূর্ব ভূমধ্যসাগর গ্যাস ফোরামকে একটি আঞ্চলিক ফোরামে রূপান্তরিত করতে গত মঙ্গলবার কায়রোতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে মিসর, ফ্রান্স, আরব আমিরাত, গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস, ইতালি, ফিলিস্তিন ও জর্ডান। এই ফোরামের মূল কাজ হবে পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং পূর্ব আফ্রিকায় আঙ্কারার অবস্থানকে দুর্বল করে তোলা।

ফ্রান্স তথা এমানুয়েল মাখোঁর আকস্মিক এই বেপরোয়া অবস্থানের কারণ কী। এটি কি শুধুই আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ফরাসি আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখতেই, নাকি অন্য কিছুর ফন্দি? ফরাসিদের এই বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে রয়েছে ইউরোপ এবং মাখোঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিপ্রায়।

প্রথমত, ব্রেক্সিট–পরবর্তী ইউরোপের নেতৃত্ব নিয়ে বার্লিন এবং প্যারিসের মধ্যকার দর–কষাকষি। অটোমানদের আমল থেকেই বার্লিন আঙ্কারার মিত্র। এই মিত্রতা রাজনৈতিক ও অর্থনীতির গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক সম্পর্ককেও স্পর্শ করেছে। যার দরুন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় আঙ্কারার শক্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ফায়দা মিলেছে বার্লিনের ভাগ্যেও। টার্কিশ-জার্মান যৌথ কোম্পানিগুলো চীন ও ফ্রান্সের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাণিজ্য করছে এবং রাজনৈতিকভাবেও বৃহৎ অর্থে বার্লিন মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব আফ্রিকায় আঙ্কারার অবস্থানকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। যদিও সিরিয়ায় পিকেকে নিয়ে বার্লিন ও আঙ্কারার মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে এবং পূর্ব আফ্রিকায় আঙ্কারাকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে আটকে ফেলতে পারলে ম্যার্কেল–পরবর্তী সময়ে ইউরোপের একক নেতৃত্বে ফরাসিরা এবং ব্যক্তিগতভাবে মাখোঁ এগিয়ে যাবেন।

দ্বিতীয়ত, ২০২২ সালের ফ্রান্সের আগত নির্বাচন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ৩৯ বছর বয়সী মাখোঁ ফ্রান্সের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে জয়লাভ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকে। মাখোঁর ওই জয়লাভ ছিল উগ্র ডানপন্থী মৌলবাদী মারিনা লা পেনের বিরুদ্ধে। মারিনা লা পেনে তাঁর ইসলাম ও অভিবাসীবিদ্বেষের দরুন ফ্রান্সের ট্রাম্প হিসেবে পরিচিত। গত জুনের স্থানীয় নির্বাচনে মাখোঁর সেন্ট্রিস্ট রিপাবলিক অন দ্য মুভ পার্টি ভরাডুবির শিকার হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনে এই ভরাডুবির পর মাখোঁ পশ্চিমের চিরচেনা পথেই হেঁটেছেন। উদারনৈতিক পন্থাকে সরিয়ে রেখে তুর্কফোবিয়া এবং আফ্রিকায় ফরাসিদের হারানো সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জাতিবাদী গল্প দিয়ে নির্বাচনে জেতার পরিকল্পনা আঁটছেন।

রাশিয়া, চীন, ভারত ও তুরস্কের মোকাবিলায় ফরাসিরা আফ্রিকায় তাদের আধিপত্য কতটা টিকিয়ে রাখতে পারবে, তা সময় বলে দেবে। তবে লিবিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট বিবাদে ফরাসিদের বিশেষ করে মাখোঁর অবস্থান মূলত ইউরোপের খ্রিষ্টান মৌলবাদী ডানপন্থীদের রাজনৈতিক আখ্যানে রসদ জুগিয়েছে। এই রসদে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা জয়লাভের আশীর্বাদ নিয়ে যদি উগ্রপন্থীরা মুসলিনি এবং তার আদর্শকে আবার ইউরোপের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলে, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

রাহুল আনজুম: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।