তুলনাহীন রাজনীতিজ্ঞ

মোহাম্মদ ফরহাদ
মোহাম্মদ ফরহাদ

ছাব্বিশ বছর আগের এক সকাল। শরতের ঝকঝকে রোদ। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে আসা ভগ্নদূতের মুখে খবরটি পেয়ে আমার অনুভূতি হয়েছিল, এ যেন মধ্যগগনে সূর্যাস্ত। তাঁর বয়সের মধ্যাহ্ন। পঞ্চাশও পূরণ করেননি। দেশের রাজনৈতিক আকাশও তখন তপ্ত, স্বৈরশাসন উৎখাতের গণ-আন্দোলনে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের আকাশের আলো ওই মুহূর্তে মিলিয়ে গিয়েছিল। আমরা ছুটেছিলাম কেউ পল্টনে পার্টি অফিসে, কেউ কাকরাইলে তাঁর বাসার দিকে। পূর্ববর্তী ৩৫ বছর যে মানুষটি দেশবাসীর স্বার্থের সকল গণ-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নিরন্তর, মাত্র ১৬ বছর বয়সে যাঁর জেলে যাওয়া শুরু, মার্ক্সবাদী আদর্শে মেহনতি মানুষের বিপ্লবী সংগ্রামে রত থেকে যিনি বিকশিত হয়ে ওঠেন জাতীয় পর্যায়ের অপরিহার্য নেতা রূপে, তাঁর জীবনাবসান ঘটে অকালে।
মোহাম্মদ ফরহাদ। তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সংসদের সদস্য। তাঁর মৃত্যুতে শুধু কমিউনিস্ট বা বাম-প্রগতিশীল নয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলের নেতা-কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীসহ সব রাজনীতিসচেতন মানুষের মধ্যে শোক দেখা দিয়েছিল, শূন্যতাবোধ সৃষ্টি হয়েছিল। একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবীর তিরোধানে এমন সর্বজনীন প্রতিক্রিয়া বিরল। কিন্তু আমাদের জাতীয় সংগ্রামগুলোর পটভূমিতে মোহাম্মদ ফরহাদের ওই অবস্থানটি তৈরি হয়েছিল আগেই। আর সে-সময় ১৫ দল ও সাতদলীয় দুটি জোটের যে স্বৈরাচারবিরোধী ‘যুগপৎ’ আন্দোলন চলছিল, অর্থাৎ পৃথক প্ল্যাটফর্ম থেকে একই কর্মসূচি দেওয়া, সেই উদ্ভাবনী কৌশলটির উদ্্গাতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। পাঁচ দফা দাবিনামার খসড়া প্রণেতাও তিনি। আন্দোলনের বৃহত্তর ঐক্যের তিনি অনুঘটক ও ভারসাম্য বিধায়ক। অল্প দিনেই একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও তখন তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পরে সরকারের সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, যিনি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না, আমাকে বলেছিলেন, ‘একজন পটেনশিয়াল ন্যাশনাল লিডারের অল্প বয়সে মৃত্যু হলো।’ তাঁর বলা ওই অল্প কয়েকটি শব্দে মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে অনেক মানুষের মূল্যায়ন ধ্বনিত হয়েছিল।
মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের দেশের এক ঐতিহাসিক কালপর্বের অন্যতম প্রধান সংগঠক-রাজনীতিবিদ। এটা শুধু রাজনৈতিক কর্মী তৈরি, তাদের আদর্শে দীক্ষিত ও সংগঠিত করা এবং লক্ষ্যাভিমুখী বহুবিধি সংগঠন-আন্দোলন গড়ে তোলার অর্থে নয়, বরং তাঁর অবস্থান ও অবদান চিহ্নিত থাকবে জাতীয় মুক্তি ও গণমানুষের শোষণমুক্তির ধারাবাহিক সংগ্রামে একটি পর্যায়ের গুণগত পর্বান্তর, রূপান্তর ও উন্মোচনের রূপকার হিসেবে। দুটি ক্ষেত্রে বিষয়টি স্পষ্টতর: প্রথমত, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অভিঘাতে এখানে বিপর্যস্ত সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের সংগ্রামের ছিন্ন সূত্রকে পুনরায় গেঁথে তুলে তাকে জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারায় সন্নিবেশিত করা; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক প্রবণতার অংশরূপেই গত শতকের ষাটের দশকে স্ফুরিত চিন্তা-চেতনা-দর্শন-বুদ্ধিবৃত্তি-মনন-স্বপ্ন-সংস্কৃতির মহা যুবজাগরণকে দেশের হাজার হাজার তরুণের মনে স্থাপন করা ও তাদের সক্রিয় করা। এই দুটি কাজ পৃথকভাবে দৃষ্টিগোচর হলেও পৃথক ছিল না, ছিল অঙ্গাঙ্গি।
নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেঙে পড়ার বৈশ্বিক পরিবর্তনের ধারায় আমাদের জাতীয় পরিস্থিতিও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু মানুষের মহৎ স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে না, ইতিহাসের কোনো ইতিবাচক অবদান চিরতরে হারায় না। আজ আমাদের দেশের তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জাতীয় অগ্রগতি সাধনের যে পথে পা বাড়িয়েছে, অভিনিবেশ নিয়ে খুঁজে দেখলে সে পথের পাথেয়, উপায়, হাতিয়ার, কাজের ধারা, কৌশল ও উপাদানের জন্য মোহাম্মদ ফরহাদকে অনেক প্রাসঙ্গিক রূপে দেখতে পাবে তারা।
দিনাজপুর জেলার গ্রামাঞ্চলে ১৯৩৮ সালে স্কুলশিক্ষক বাবার ঘরে মোহাম্মদ ফরহাদের জন্ম। কলেজ পর্যন্ত শিক্ষা দিনাজপুরে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ।
১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য নিজ হাতে লিখিত জীবনবৃত্তান্তের একাংশে তাঁর বিনীত ভাষ্য: ‘বাল্য বয়স থেকে আমার গোটা জীবনই হলো রাজনৈতিক জীবন। নীতি-আদর্শ, দল কখনো পরিবর্তন করি নাই। ’৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে শরিক থেকেছি এবং এখনো আছি।’
মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন আমাদের কালের এক অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক রণকৌশলবিদ। তাঁকে ১৯৬০-৬২-এর আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করা হয়। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করে ওই আন্দোলনের তিনিই ছিলেন কর্মসূচি ও কৌশলপ্রণেতা প্রধান সংগঠক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচিকে ধারণ করে ছাত্রসমাজের ১১ দফায় পরিণত করার প্রধান রূপকার তিনি। ১৯৬৯-এ ‘গণ-অভ্যুত্থান’ শব্দচয়ন তাঁরই। ১৯৭১-এ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ার পূর্বচিন্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনী তৈরির পরিকল্পনাও তাঁরই। প্রতিভাধর ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন স্বৈরশাসক এরশাদকে নির্বাচনের মাধ্যমে হঠানোর জন্য দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সংসদের ১৫০: ১৫০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তাব দিয়ে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু ভয় পেয়ে এরশাদ একজনের পাঁচটির বেশি আসনে না দাঁড়ানোর বিধানের অধ্যাদেশ জারি করে নৈতিক পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন।
গত দুই দশক দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র বহাল থাকলেও বিদ্বেষ-সংঘাতপূর্ণ গোঁয়ার্তুমির রাজনীতির ধারায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কৌশলের নিম্নমান আমাদের পীড়িত করছে। রাজনীতিতে জ্ঞান, বুদ্ধি ও পরিশীলিত সংস্কৃতি আমরা দেখতে চাই।
শোষণ-বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজের লক্ষ্যে রাজনীতির বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞে মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিস্ট পার্টির প্রশস্ত ভিত হিসেবে গড়ে তুলছিলেন ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, নারী প্রভৃতি গণসংগঠন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক গড়তেও তাঁর মনোযোগ ছিল গভীর। তিনি ছিলেন এক পরিপূর্ণ রাজনীতিজ্ঞ। সব কাজ বিপ্লবে নিবেদিত। জীবন উৎসর্গিত স্বদেশ, মানুষ ও মানবতার মুক্তি ও কল্যাণে। তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল ৪৯ বছর বয়সে, ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর।
মোজাম্মেল হোসেন: সাংবাদিক।