দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন মুদ্রা

সম্প্রতি ভারত সফরের সময় অর্থমন্ত্রীর আরেকটি অসতর্ক মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। যদিও তা গণমাধ্যমের দৃষ্টি সেভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু দেশের জন্য এর যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সদস্যদেশগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন মুদ্রা প্রচলনের জন্য ভারতের একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন মুদ্রা প্রচলনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতকে ভূমিকা নিতে হবে’ (ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেস, ৪ মে ২০১৩)। মন্তব্যটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট মান্ডেলের (১৯৬১) বিখ্যাত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আঞ্চলিক অভিন্ন মুদ্রার ধারণাটি অর্থনীতিতে গুরুত্ব লাভ করে। পরবর্তীকালে একই বিষয়ে আরও দুটি প্রবন্ধ লেখেন রোনাল্ড ম্যাককিনন (১৯৬৩) এবং পিটার কেনেন (১৯৬৯)। এই তিনটি প্রবন্ধই আঞ্চলিক অভিন্ন মুদ্রার কার্যকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন কারণে সংশয়ী ছিল।

অভিন্ন মুদ্রার অর্থনীতি একটি জটিল তাত্ত্বিক বিষয়। অভিন্ন মুদ্রা অঞ্চলে একটি অভিন্ন সাধারণ মুদ্রা থাকতে পারে অথবা সদস্যদেশগুলো তাদের নিজস্ব মুদ্রা ধরে রাখতে পারে কিন্তু সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক মুদ্রার বিনিময় হারকে সম্পূর্ণ স্থির রাখতে হবে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিশ্লেষণের পর ইউরোপে একটি একক সাধারণ মুদ্রা অঞ্চল গঠিত হয়। তার পরও এর পেছনে অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকে রাজনৈতিক বিবেচনাই মুখ্য ছিল। ইউরোপে এই অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট বিতর্ক হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য কিংবা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য একটি অভিন্ন মুদ্রা প্রচলনের বা অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের লাভ-ক্ষতি নিয়ে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত গবেষণা হয়নি। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক একত্রীকরণের বা সম্পৃক্ততার জন্য অতি উদ্গ্রীব, সেসবও এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেনি। মন্ত্রিপরিষদ কিংবা জাতীয় সংসদ—কোনোটিই রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যমণ্ডিত এই বিষয়ে আলোচনা করেনি। তাই এটি স্পষ্ট নয় যে অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যের ভিত্তি কী। তিনি কি স্বভাববশত ভারত যা করার জন্য তাগিদ দিচ্ছে তারই পুনরাবৃত্তি করছেন? নাকি এটি তাঁর অসমীচীন বক্তব্যেরই আরেকটি নমুনা মাত্র?

অভিন্ন সাধারণ মুদ্রা প্রচলনের পক্ষে প্রথাগত যুক্তি হলো, এটি বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের খরচ এবং মুদ্রা বিনিময় হারের অনিশ্চয়তা কমিয়ে অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিগূঢ় করবে। কিন্তু, অভিন্ন মুদ্রার প্রচলন অবধারিতভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করে না। আবার অভিন্ন মুদ্রা না থাকাও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নিবিড়তা ব্যাহত করে না। বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে দৃঢ়সম্পৃক্ত কিছু দেশের (যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা, তুরস্ক-ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড) প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব পৃথক মুদ্রা রয়েছে। আবার মধ্য আমেরিকার কিছু দেশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েকটি দ্বীপ দেশ মার্কিন ডলারকে তাদের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে কিংবা করেছিল। কিন্তু এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ডলার ব্যবহারকারী অন্য দেশগুলোর সঙ্গে এই দেশগুলোর বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা তেমন বাড়ায়নি। একইভাবে ১৯৯৯-পরবর্তীকালে একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালুর পর ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা আগের তুলনায় তেমন বাড়েনি। ইউরোপে একক সাধারণ মুদ্রার প্রচলন যতটা না অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণ, তার থেকে বেশি হলো অর্থনৈতিক সম্পৃক্তির পরিণতি।

দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সাধারণ মুদ্রা প্রচলনের অব্যবহিত ফল হবে দেশগুলোর স্বতন্ত্র মুদ্রানীতিকে অকার্যকর করে ফেলা। একটি অভিন্ন মুদ্রার আওতাভুক্ত অঞ্চলের বা অর্থনৈতিক ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোর স্বতন্ত্র মুদ্রানীতি ও নিজস্ব বৈদেশিক বিনিময় হার নীতি থাকতে পারে না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও প্রয়োজনীয়তা হারায় এবং এগুলো একটি দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতো স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারবে না, বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেট বা বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয় এখন যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অফিস হিসেবে কাজ করে, ঠিক তেমনি তখন বাংলাদেশ ব্যাংক দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা অফিস হিসেবে কাজ করবে।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক বাস্তবতা এমনই যে একটি অভিন্ন মুদ্রা কার্যত ভারতীয় রুপিকেই নির্দেশ করে। ভুটান ও নেপালে নিজস্ব মুদ্রার পাশাপাশি ভারতীয় রুপির ব্যবহার সেটিই ইঙ্গিত করে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতের অবদান ৮০ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে যোগদান করবে, সেটা অবিশ্বাস্য। তাই দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ইউনিয়ন পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ইউনিয়নের মোট জিডিপিতে ভারতের অবদান ৯০ শতাংশের বেশি হবে। অভিন্ন মুদ্রা অঞ্চলে সদস্য সব কটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মুদ্রা বিলুপ্ত হয়ে প্রতিস্থাপিত হবে একটি দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে, যার একটি অভিন্ন মুদ্রা থাকবে। এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সদস্য সব দেশেরই প্রতিনিধিত্ব থাকলেও তাদের ভূমিকা হবে সীমিত। কেননা, এখানে সিদ্ধান্ত হবে ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে। আর তাই অভিন্ন মুদ্রাটি কার্যত প্রধান ও বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের রুপিরই একটি নতুন সংস্করণ হবে।

এ ব্যবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে, যদি নিশ্চিত করা যায় যে নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভারতীয় সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে কার্যকর ও নিরপেক্ষভাবে আঞ্চলিক মুদ্রানীতি পরিচালনা করতে পারবে। যখন ভারতের মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বাংলাদেশের থেকে ভালো নয় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জনগণের সঙ্গেই ভারতের তেমন সুসম্পর্ক নেই, তখন এমনটি ভাবা কঠিন।

যদি এসব বিষয়েরই সন্তোষজনক সমাধান হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠিত হয়, তাহলে কি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে? মান্ডেল, ম্যাককিনন ও কেনেনের বিশ্লেষণ এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নে ভারতের অর্থনীতি বেশ ভালো চলছে, রপ্তানি বাড়ছে, প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসছে এবং প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। তাই ইউনিয়নের লেনদেনের ভারসাম্য ও অভিন্ন মুদ্রাটি শক্তিশালী হবে এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না—রপ্তানি স্থবির, বিদেশি বিনিয়োগ সীমিত ও প্রবাসী আয় পরিমিত। এই অবস্থায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ক্রমাবনতি হবে। এ থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের প্রয়োজন সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদ ও নিজস্ব মুদ্রার বিনিময় হার কমানো।

কিন্তু অর্থনৈতিক ইউনিয়নভুক্ত হলে এর কোনোটিই সম্ভব নয়, যেহেতু এর কোনোটির ওপরই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তখন একমাত্র উপায় হবে সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতি, যা সরকারকে ঋণ নিতে বাধ্য করবে। ঋণের উৎস যা-ই হোক না কেন, জাতীয় ঋণ ও পরিশোধের দায় বেড়ে যাবে। সম্প্র্রসারণমূলক রাজস্বনীতি আমদানিকেও উৎসাহিত করবে। এতে বাণিজ্যের ভারসাম্যে অধোগতি হবে। যদি এই অবস্থার পরিবর্তন না ঘটে, তবে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকবে, বাড়বে ঋণ পরিশোধের দায়ও।

দেখা যাচ্ছে, ভারতের অর্থনীতির জন্য যেখানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন সম্প্র্রসারণমূলক নীতি। এর ফলে অর্থনৈতিক ইউনিয়নে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেবে।     

বেকারত্ব কমাতে যদি বাংলাদেশের শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অন্য কোথাও সহজে যেতে পারেন কিংবা মজুরি যদি নমনীয় হন, তাহলে সমস্যাটা লাঘব হতে পারে। বাস্তবে মজুরি সাধারণত কমে না। তাই বেকারত্ব বাড়লেও মজুরি উল্লেখযোগ্য কমবে না। এমতাবস্থায় একমাত্র সমাধান হলো ইউনিয়নের সর্বত্র শ্রমিকের অবাধ চলাচল। অথবা এক দেশের রাজস্ব মন্দাক্রান্ত অন্য দেশে সরবরাহ করে অর্থনীতি চাঙা করা।

দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ বাস্তবে কতটুুকু সম্ভব? যেখানে ভারত বাংলাদেশকে কাঁটাতারের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে এবং সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা নিয়মিত ঘটনা, সেখানে বেকার শ্রমিক সহজেই সীমান্ত পার হতে পারবে, এটা ভাবা দুষ্কর। আবার মন্দায় আক্রান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে ভারত একতরফাভাবে সম্পদ সরবরাহ করবে—এর সম্ভাবনা কতটুকু। বিগত কয়েক শ বছরের ভারতীয় ইতিহাস উল্টো সাক্ষ্য দেয়।

তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অবাধ শ্রম চলাচল সম্ভব হতেও পারে, যদি সদস্যদেশগুলো একটি প্রকৃত অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছায়। অন্যদিকে আন্তর্দেশীয় রাজস্ব বণ্টন সম্ভব হতে পারে, যদি সদস্যদেশগুলো একটি রাজনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে সম্মত হয়। বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়া কি আদৌ এই মৌলিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত?

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো যদি একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠন করে, তবে কিছু অননুমেয় ও অপ্রতিরোধ্য শক্তির উদ্ভব হবে যেগুলো তাদেরকে একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে অথবা অর্থনৈতিক ইউনিয়নকেই ভেঙে দেবে। সে জন্য অর্থনৈতিক একত্রীকরণের যেকোনো উদ্যোগ নিতে হবে সচেতনভাবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে, তড়িঘড়ি করে নয়।

l এম এ তসলিম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।