দয়া করে আমাদের ভুল বুঝবেন না

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেই সুবাদে ১৯৭৮ থেকে এই ক্যাম্পাসে আছি। শিক্ষকতার বয়সও প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই করছে। আরও অনেকের মতোই বিদ্যাচর্চা আমাকে শিখিয়েছে মুক্তচিন্তার সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরা আর নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রত্যেকের দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি, আধুনিক মনস্কতা ও সাংস্কৃতিক বোধ মানুষকে বড় করে। মধ্য যুগের ইউরোপে এগারো শতক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকে। জ্ঞানচর্চাকে বৈশ্বিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি মুক্তচিন্তা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার প্রায় ৩০০ বছর আগেই আমাদের এই ভূখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগারো শতকে নেপাল, তিব্বত ও চীনে বৌদ্ধধর্ম যখন বিপন্ন দশায় পৌঁছায়, তখন সেসব দেশের শাসক ও ধর্মগুরুরা বৌদ্ধ জ্ঞানের নব উত্থান ঘটানোর জন্য বাঙালি পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করকে অনুরোধ করে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজ নিজ দেশে। জ্ঞানের এমন আন্তপ্রবাহ ঘটে বলেই বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করে।
অথচ একুশ শতকের এই আধুনিক সময়ে নষ্ট রাজনীতি আর পদলোভের পঙ্কে অবগাহন করা কতিপয় শিক্ষক আন্দোলনের নামে শেষ পর্যন্ত কূপমণ্ডূকতার বিবর্ণ পোশাকে লাঞ্ছিত করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ধারণাকে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমান শিক্ষক, অফিসার, কর্মচারী সবাইকে।
শিক্ষক নামের এই চিহ্নিত রাজনীতিকেরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার ভেতরে আটকে ছিলেন শুরু থেকেই। তাঁদের সংকীর্ণ এবং অসংস্কৃত আচরণের প্রকাশ প্রায় এক বছর আগে আতঙ্কের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছিলাম। যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব মহামান্য চ্যান্সেলর অর্পণ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ওপর। সরকারি ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শ্রেণীর শিক্ষক, যাঁদের দৃষ্টি থাকে নানা পদ-পদবির দিকে এবং যাঁর যাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ে বন্দী থাকতে পছন্দ করেন, তাঁরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছিলেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে ভিসি হিসেবে তাঁরা গ্রহণ করবেন না। যেদিন নবনিযুক্ত ভিসি যোগদান করবেন এর আগের দিন শিক্ষক সমিতি সাধারণ সভা আহ্বান করেছিল। সেখানে অবৈশ্বিক কূপমণ্ডূক ছকে আটকে থাকা শিক্ষকদের কেউ কেউ ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভিসি হিসেবে ঢুকতে দেবেন না বলে অগ্নিঝরা বক্তব্য দিতে থাকেন। কেউ কেউ কাফনের কাপড় পরে প্রতিবাদ জানাবেন।
মনে পড়ে, সম্ভবত সেই সভার শেষ বক্তা হিসেবে আরও অনেকের মতোই আমি ভিন্নমত রেখে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সরকার ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে কেন বাধ্য হয়েছে, তা আমার বিবেচনামতো ব্যাখ্যা করেছিলাম। আন্দোলনবিধ্বস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে সাময়িক নিয়োগ পেতে যখন আমরা একমত হতে পারিনি এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষক যখন নিয়োগ পেতে ছোটাছুটি শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দরবারে, তখন কোনো সরকারই নতুন করে ঝামেলা কিনতে রাজি হবে না। তাই তৃতীয় পক্ষ থেকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া সরকারের স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত ছিল। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে কোথাও লেখা নেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চল থেকে কোনো শিক্ষাবিদকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ‘নিজেদের’ ছাড়া অন্য কাউকে ভিসি হিসেবে গ্রহণ করতে না পারা সংকীর্ণ ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য ড. আনোয়ার হোসেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দিয়ে সিনেটরদের ভোটে প্যানেল বিজয়ী হয়েছিলেন। এভাবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তিনিই একমাত্র নির্বাচিত ভিসির সম্মান নিয়ে আছেন। এ কারণে স্বভাবতই তিনি শক্ত অবস্থানে আছেন।
রাজনীতিসংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনোয়ারের অবস্থানকে সহ্য করতে পারছিলেন না। নিকট অতীতে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগী ভিসি পুনরায় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে একধরনের প্রতিশোধ নিতে চান বলে জনশ্রুতি আছে। তাই দুর্বল যুক্তির ওপর দাঁড়ানো ভিসিবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক সমিতির নাম ব্যবহার করলেও এর চালিকাশক্তি ছিল একটি শিক্ষক গ্রুপ। আওয়ামী লীগের আরও কয়েকটি গ্রুপ এবং বাম ঘরানার শিক্ষকেরা এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসেন। বাম ধারার শিক্ষকেরা একাধিকবার বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সাধারণ শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। কোনো ব্যানারের শিক্ষার্থীরাই এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন না। শুধু রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য বিএনপি ঘরানার শিক্ষকদের একটি অংশ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। তার পরও একরকম গায়ের জোরে আন্দোলনকারীরা প্রায় দেড় মাস ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে শিক্ষাজীবনের অপূরণীয় ক্ষতি করেন।
গ্রীষ্মের ছুটির পর নানা অঞ্চলের মানুষ ও ছাত্র-শিক্ষকদের সমালোচনার মুখে ক্লাস-পরীক্ষা আন্দোলনের আওতার বাইরে রাখতে বাধ্য হন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা। এর বদলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করার জন্য ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে প্রশাসনিক ভবন অবরুদ্ধ করে রাখেন। ভিসি অবাঞ্ছিত ঘোষিত হলেও অবরোধের কারণে দুই সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রারসহ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস করতে পারেননি দীর্ঘদিন। প্রতিদিন দু-চারজন রাজনীতিক শিক্ষক প্রশাসনিক ভবন কম্পাউন্ডে বসে পাহারা দিতেন, যাতে কেউ এখানে প্রবেশ করতে না পারে। আমার এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরে বন্ধু প্রচারণাটি বিশ্বাস করতে না পেরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে এসে বিস্ময়ের সঙ্গে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। শিক্ষকদের এমন অবরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজের দারুণ ক্ষতি হচ্ছিল। সাধারণ যুক্তি ও অনুরোধে সাড়া না দেওয়ায় অবশেষে ক্ষতিগ্রস্ত তিনজন শিক্ষক ও একজন ছাত্র হাইকোর্টে রিট করেন। শেষে বিজ্ঞ আদালত আন্দোলনকারীদের অবরোধ উঠিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। এভাবেই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়।
আন্দোলনকারীরা এতটাই মরিয়া যে কারও নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাই রিটকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুণ্ডুপাত করেছেন নানা বিবৃতিতে। আন্দোলনের অসারতা প্রমাণিত হতে থাকলে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা। এতে যে ক্ষুব্ধতার জন্ম হয়, তাতে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা ভুলে যান। এরই কলঙ্কিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত ৩০ জুলাই। সাধারণ শিক্ষক পর্ষদের দেওয়া একটি লিফলেট থেকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জানা যায়, একজন সিনিয়র সহকারী প্রক্টর তাঁর দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন রেজিস্ট্রার মহোদয়ের কক্ষে। সেখানে রেজিস্ট্রার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দুই সহ-উপাচার্য এবং সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। ঘটনাক্রমে এই সহকারী প্রক্টর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আন্দোলনকারীদের বিবেচনায় ভিসি মহোদয়ের মতো তিনিও ‘বহিরাগত’।
লিফলেটের ভাষায়, ‘এ সময় বাইরে থেকে কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষক হঠাৎ সহকারী প্রক্টরের নাম ধরে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও চিৎকার করে তাঁকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বলে তাঁকেও “অবাঞ্ছিত” ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার জন্য তাঁরা উদ্যত হন।’
প্রচারিত লিফলেটের বক্তব্য যদি সত্য হয়, তবে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। লজ্জা আমাদের আরও বেশি, আমরা যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বা এখনো যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইতিমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের অনেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা একইভাবে নিজেদের লজ্জিত ও বিব্রত হওয়ার কথা বলেছেন। এই ক্যাম্পাসের একটি সুনাম রয়েছে যে লেখাপড়ার পাশাপাশি এখানকার শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতিসচেতন। ক্যাম্পাসের অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন কৃতিত্বের সঙ্গে তাদের কর্মভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রয়াত নাট্যাচার্য সেলিম আল দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলেছিলেন। এই অহংকার ক্যাম্পাসবাসী ধারণ করে। এখন আলোকিত ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতার শিক্ষকদের আচরণে দারুণ হতাশ। ওদের সরল উচ্চারণ, ‘অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সামনে তো আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জো নেই।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা অনেক ছাত্র এবং কর্মকর্তা একইভাবে বিব্রত হওয়ার কথা বলেছেন।
এ কারণেই আমি সচেতন দেশবাসীর কাছে নিবেদন করছি, আমরা যাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আছি, দয়া করে আমাদের ভুল বুঝবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছুসংখ্যক শিক্ষক কায়েমি স্বার্থে আন্দোলনে নেমে বারবার হোঁচট খেয়ে এখন হতাশ। ফলে তাঁরা যেভাবে কূপমণ্ডূকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের স্বাভাবিক চিন্তার প্রকাশ নয়।
এই ক্যাম্পাসের অধিকাংশ মানুষই সুস্থ চিন্তার চর্চা করে। আমরা আমাদের ক্যাম্পাসকে বৈশ্বিক দৃষ্টিতেই দেখতে চাই। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টিতে বিশাল হতে চাই সবাইকে বুকে নিয়েই। আমরা আশা করব, আন্দোলনকারীরাও সংবিৎ ফিরে পাবেন। সামান্য চাওয়া-পাওয়ার জন্য শিক্ষক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না। তাই আপনারা দয়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]