দুঃসময়ে কাছে থেকেছে প্রথম আলো

আবুল কালাম আজাদ

আবুল কালাম আজাদ, আমার ভাই। এটি তার সার্টিফিকেটের নাম। তবে কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক অঙ্গনে, পরিবারে ‘বিপ্লব’ নামে পরিচিত ছিল সে। বয়সে আমি তার চেয়ে বড়, তিন বছরের ব্যবধান। কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার বেলায় কোনো নির্ধারিত নিয়ম থাকে না। তবু আমরা ধরে নিই, বয়সে যে বড়, সে যাবে সবার আগে। সে অর্থে শতবর্ষের কাছাকাছি বৃদ্ধ বাবা অথবা বয়সে বড় আমারই যাওয়ার কথা ছিল। না, নিয়ম ভেঙে সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে সে চলে গেল—প্রিয়-অপ্রিয় সবটা উপেক্ষা করে।
১২ জুলাই বমি, পেটব্যথার খবর জানলাম অফিসে। সহকর্মীরা সার্বক্ষণিক ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। ধর্ম, পেশাগত অবস্থান—সব উপেক্ষা করে বারবার অনেকেই বলেছেন, রক্তের প্রয়োজন হলে তাঁদের খবর দিতে। দু-তিনটি হাসপাতাল ঘোরার পর রাত ১১টার দিকে জানা গেল ডেঙ্গু।

রোগ শনাক্ত হওয়ায় নিশ্চিত হলাম, এবার ভালো হবে দ্রুত। যদিও কোনো কিছুতেই বমি কমছিল না। প্লাটিলেটও এতটা কম ছিল না, যাতে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তথাপি অফিস থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, চিকিৎসার জন্য অর্থ বা রক্তের প্রয়োজন হলে যেন তাদের অবগত করা হয়।

করোনা মহামারির মধ্যে হাসপাতালের ওয়ার্ডভর্তি ডেঙ্গু রোগী। বাইরে বিধিনিষেধ। ডাব এনে খাওয়াব, তারও উপায় নেই। বমি কিছুতেই কমছিল না। তারপরও একবারের জন্য মনে হয়নি, এটাই ওর শেষ সময়। কষ্টে সারাক্ষণ মাকে ডাকছিল। মৃত মায়ের নাম ওকে প্রশান্তি দিচ্ছিল হয়তো। বুকের মধ্যে অসুস্থ ভাইয়ের মাথাটা নিয়ে ভাবছিলাম, করোনা হলে এ দেশের কেউ কেউ স্বজনকে একা ফেলে পালিয়ে যায়। কী করে পারে!

কাজপাগল ভাই আমার এতটা কষ্টের মধ্যেও জানতে চেয়েছে, তার সহকর্মী বিকাশদাকে বর্তমান অবস্থা বলেছি কি না! আরেক সহকর্মী গৌরাঙ্গদা রক্ত দিতে চেয়েছেন, রক্ত দরকার হলে তাঁকে যেন ফোন করি। জহির ভাই এখন অন্য পত্রিকায়, সুমনের মাধ্যমে হয়তো তিনি খবর পেয়ে যাবেন। কিন্তু একবারও সে ভাবেনি, সে আর ফিরবে না সন্তানদের কাছে, প্রিয় সহকর্মীদের সান্নিধ্যে।

বিআরবি হাসপাতালে নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের ছিল না। বিপ্লবের অবস্থার অবনতি, ওর কষ্ট আর হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের অবহেলা মানতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চতুর্থ হাসপাতাল পান্থপথে বিআরবিতে গেলাম; আর্থিক অবস্থার কথা না ভেবেই। দেখামাত্রই চিকিৎসক জানালেন, দেরি হয়ে গেছে। আইসিইউ থেকে লাইফ সাপোর্ট পর্যন্ত সময় ছিল না। চলে গেল পৃথিবীর সব জটিলতাকে পেছনে ফেলে। সংসার, প্রতিষ্ঠান, সাফল্য, লাভ-ক্ষতির হিসাব—সবটা ফেলে চলে গেল তার নিজের মতো। কোথাও কোনো ঋণ, কোনো দায় রইল না জীবনে; সংসারের, সম্পর্কের অনেক জটিলতা বুঝত না সে। তাই জটিলতাবিহীন যাত্রা, মসৃণ পথে চলে যাওয়া ছিল ললাটে তার।

বিপ্লবের এমন আকস্মিক প্রস্থানে গোটা পরিবারের চোখে তখন অন্ধকার। ভবিষ্যতের দিনগুলো নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা। শতবর্ষের কাছাকাছি অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা, গৃহিণী স্ত্রী, দুটি নাবালক ছেলে নিয়ে একদম রোজগারবিহীন শূন্য পরিবারের পাশে দাঁড়ায় তখন প্রথম আলো। হাসপাতালের বিল পরিশোধ থেকে শুরু করে সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর মোটামুটি ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা আর ভালোবাসার হাত প্রসারিত করে প্রথম আলো আমাদের পাশে থেকেছে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এ বছর বিপ্লব ছিল না। প্রথম আলো পরিবার ভুলে যায়নি তাদের এ সদস্যকে। বাসায় এসেছে তারা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর খরচ থেকে কিছুটা সাশ্রয় করে সে অর্থ তুলে দিয়েছে এতিম দুই সন্তান ও তার বিধবা স্ত্রীর হাতে।

করোনাকালে দেশের অনেক সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতা আটকে যাওয়াসহ নানা সংকটের কথা আমরা শুনেছি। সেখানে প্রথম আলো বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো, অভিভাবকের মতো এভাবে আমাদের পাশে থাকায় আমরা অভিভূত। আমাদের গোটা পরিবার কৃতজ্ঞ বিপ্লবের প্রতিষ্ঠান, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি। আমি বলব, কর্মীদের দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে প্রথম আলোর ভূমিকা অনন্য। আমরা প্রথম আলোর উন্নতি আর কল্যাণ কামনা করি।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া

বিপ্লবের বড় বোন
৮৭, মুরাদপুর, মাদ্রাসা রোড
ঢাকা ১২০৪।